মিলিটারিই তো সরকারের কাজে বাধা দেয়, ফুঁসলেন নওয়াজের ভাই; পাকিস্তানের গণতন্ত্র কিছুটা হলেও এগোচ্ছে
পাকিস্তানে এমনটি বিশেষ চোখে পড়ে না। বা বলা যায়, এমন ঘটনা ওদেশে যে ঘটতে পারে, তা এককথায় অভাবনীয়। কিনতু তবু তা ঘটেছে। পাকিস্তানের প্রথম সারির দৈনিক 'ডন' বৃহস্পতিবার (অক্টোবর ৬) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানায় যে দেশের অসামরিক নেতৃত্ব তাদের সামরিক বাহিনীকে পাকিস্তানের ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ার ব্যাপারে সাবধান করে এবং বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে ঐকমত্য হওয়ার আবেদন জানায়।
'ডন' আরও জানায় যে গত সোমবারের (অক্টোবর 3) সর্বদলীয় বৈঠকের পর দু'পক্ষ অন্তত দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
প্রথমত, পাকিস্তানের আইএসআই ডিজি জেনারেল রিজওয়ান আখতার এবং সেদেশের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা নাসের জানজুয়া পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের আধিকারিকদের জানাবেন যে এরপর থেকে যদি দেশের আইনরক্ষকরা কোনও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়, সামরিক আধিকারিকরা তাতে নাক গলাতে পারবেন না। অর্থাৎ, সন্ত্রাসবাদকে আড়াল করা চলবে না।
আর
দ্বিতীয়ত,
যা
ভারতের
পক্ষে
সুখবরও
বটে,
পাক
প্রধানমন্ত্রী
নওয়াজ
শরিফ
স্পষ্ট
নির্দেশ
দিয়েছেন
জানুয়ারিতে
পাঠানকোটে
হওয়া
হামলার
তদন্ত
শেষ
করার
জন্য।
এবং,
২০০৮
সালের
মুম্বই
হামলা-সম্পর্কিত
আটকে
থাকা
মামলাগুলি
পুনরায়
চালু
করতে
'ডন'-এর
মতে,
এই
অভূতপূর্ব
সিদ্ধান্তগুলি
নেওয়া
হয়
পাঞ্জাব
প্রদেশের
মুখ্যমন্ত্রী
শাহবাজ
শরিফ,
যিনি
প্রধানমন্ত্রীরই
ভাই,
এবং
ডিজি
আখতার-এর
মধ্যে
উত্তেজিত
কথোপকথনের
পর।
'ডন'-এর সঙ্গে এরপর এই সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থিত থাকা আধিকারিকদের কথা হয় তবে তাঁদের কেউই 'অন দ্য রেকর্ড' কথা বলতে রাজি হননি।
জানা গিয়েছে যে সোমবারের সর্বদলীয় বৈঠকে পাকিস্তানের বিদেশসচিব এজাজ চৌধুরী একটি উপস্থাপনা করেন সামরিক এবং অসামরিক আধিকারিকদের সামনে। তাতে তিনি জানান যে ইসলামাবাদের নানা প্রয়াসের পরেও আন্তর্জাতিক দুনিয়া পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। এর ফলে, পাকিস্তান ক্রমেই কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে চৌধুরী জানান যে হাক্কানি নেটওয়ার্ক-এর বিরুদ্ধে যদ্দিন না কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, ততদিন ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ভালো হবে না। ভারত সম্পর্কে উনি বলেন পাঠানকোট মামলার নিস্পত্তি এবং জঈশ-ই-মহম্মদ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াই নয়াদিল্লির প্রধান দাবিগুলির মধ্যে পড়ে।
এমনকি, উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে এজাজ বলেন যে বিস্বস্ত বনধু চিনও চায় পাকিস্তান এবার তার নীতিতে বদল আনুক। যদিও রাষ্ট্রসংঘে ভারতের জয়েশ নেতা মাসুদ আজহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আবেদনের বিরোধিতা করেছে চিন, কিনতু বার বার এই একই অবস্থান নেওয়ার যুক্তি সম্পর্কেও তারা প্রশ্ন তুলেছে বলে জানিয়েছে 'ডন'-এর প্রতিবেদন।
এরপরেই ঘটনা নাটকীয় মোর নেয়। ডিজি আখতার, যিনি ওই বৈঠকে সামরিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ছিলেন, প্রশ্ন তোলেন তাহলে কিভাবে পাকিস্তানের এই কোনঠাসা হওয়া আটকানো যাবে?
এর সরাসরি উত্তরে এজাজ বলেন: সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার যা যা দাবি, তা সব মেনে নিয়ে। আইএসআই আধিকারিক আখতার এর প্রত্যুত্তরে যখন বলেন যে সরকার যাকে মনে করে তাকে ধরতেই পারে, তখন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সোজাসুজি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন।
তিনি বলেন অতীতে যখনই সরকারের পক্ষ থেকে কোনও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, দেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ আড়ালে থেকে সুতো টেনে তাদের রেহাইয়ের পথ খুলে দিয়েছে। 'ডন'-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈঠকে কক্ষে তখন সবাই হতবাক, নিশ্চুপ।
এরপর মধ্যস্থতা করেন স্বয়ং প্ৰধানমন্ত্ৰী, যিনি এই বৈঠকের পৌরোহিত্য করছিলেন। তিনি বলেন আইএসআই ডিজিকে কোনোভাবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে না। শাহবাজ যা বলেছেন তা সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির কথা।
অবশ্য, ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা এজাজ চৌধুরীর উপস্থাপনা এবং শাহবাগের তেড়েফুঁড়ে আসা আসলে প্রধানমন্ত্রীর মস্তিস্কপ্রসূত। দেশের সামরিক কর্তাদের নাড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের এই দুঃসময়ে সহযোগিতা পাওয়ার উদ্দেশেই তিনি তা করান। শরিফ যে সাফল্য পাননি তা বলা যায় না। কারণ, এরপরেই ডিজি আখতার বেরিয়ে পড়েন প্রদেশ সফরে।
পাকিস্তানি গণতন্ত্র গুটি গুটি এগোচ্ছে
পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন ঘটনা বলতে গেলে বিরলই। যে-দেশে অতীতে সামরিক নেতৃত্ত্ব অসামরিক নেতাকে ফাঁসিতে অবধি ঝুলিয়েছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে প্রায় পুরোটাই একপেশে দাপট দেখিয়েছে, দেশের বিদেশনীতিতে কর্তৃত্ব ফলিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অসামরিক নেতৃত্ত্বের এই ফুঁসে ওঠা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
এই ঘটনা এটাই প্রমান করে যে অসামরিক নেতৃত্ব যতই দুর্নীতির অভিযোগে ডুবে থাকুক না কেন, শাসনযন্ত্রে মিলিটারির খবরদারি যে আদৌ একটি রাষ্ট্রকে সঠিকপথে চালিত করতে পারে না। পাকিস্তান তার মূল্য চুকিয়েছে দীর্ঘদিন। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে অতটা চোখে পড়েনি, কারণ ওই বছর থেকে টানা ক্ষমতায় রয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। অর্থাৎ, পাকিস্তানের গণতন্ত্র হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে হলেও এগোচ্ছে।
আশার কথা সেটাই।