ব্রিকস সম্মেলনের আগে চিনের কণ্ঠে ভারতের প্রশংসা; পাকিস্তান কি আরও কোনঠাসা হতে চলেছে?
আগামী ১৫-১৬ অক্টোবর গোয়াতে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা) সম্মেলনের প্রাক্কালে বেজিং-এর পক্ষ থেকে দু'টি আশার কথা শোনানো হল ৷ পাকিস্তানের সঙ্গে ঘোর টানাপড়েন এবং ইসলামাবাদের পিছনে বেজিং-এর বারংবার সমর্থনের মাঝে নয়াদিল্লির কাছে যা বড় রকমের কূটনৈতিক জয়েরই সামিল ৷
কী সেই দু'টি আশার কথা?
প্রথমত, এনএসজি বা নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ-এ ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চিন নানারকম "সম্ভাবনা" নিয়ে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৷ কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমের নানা দেশ ভারতের এনএসজিতে যোগদান করার ব্যাপারে সায় দিলেও প্রবল বিরোধিতা জানায় চিন ৷ এনপিটি চুক্তিতে সই না করা ভারতকে কিসের ভিত্তিতে এনএসজিতে যোগদানের ছাড়পত্র দেওয়া হবে, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলে বেজিং ৷ এমনকি, ভারতের বৈরী পাকিস্তানের এনএসজিতে প্রবেশের পক্ষেও সওয়াল করে তারা ৷
তাই চিনের সেই কড়া অবস্থানে এহেন শিথিলতা দেখানো নয়াদিল্লির কাছে আশামূলক মনে হতেই পারে ৷ বিশেষ করে, বার্তাটি যখন দিয়েছেন সে-দেশের এক উচ্চ পদাধিষ্ঠিত কূটনীতিবিদ, একদম ব্রিকস সম্মেলনের মুখেই ৷
গত মাসে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকেও জানানো হয় যে বেজিং-এর সঙ্গে তারা গুরুত্বপূর্ণ বাক্যালাপ চালু রেখেছে এনএসজিতে প্রবেশের বিষয়টির উপরে ৷ চিনের উপ বিদেশ মন্ত্রী লি বাওদং বেজিং-এ সাংবাদিকদের জানান যে চিন এবং ভারতের মধ্যে ভারতের এনএসজিতে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সদর্থক কথাবার্তাই হয়েছে এবং চিন আরও আলোচনাতে আগ্রহী ৷
বাওদং ও জানান যে এনএসজিতে নতুন সদস্যের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে বর্তমান সদস্যদের একমত হওয়া জরুরি ৷ বলেন, এমন নয় যে এনএসজিতে নতুন সদস্যের প্রবেশের নিয়মাবলী চিন নিজেই বানিয়েছে ৷ ব্রিকস সম্মেলনে স্বয়ং চিনা রাষ্ট্রপতি জি জিনপিং-এর গোয়া আগমনের কিছু আগে বেজিং-এর দিক থেকে এই অকঠোর বার্তা যে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷ ব্রিকস সম্মেলন চলাকালীনই জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে এনএসজি প্রসঙ্গে আলোচনা হবে বলে জানা গিয়েছে ৷
পাকিস্তানকে উপেক্ষা করার বিষয়ে চিনের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই
দ্বিতীয়ত, এবারের সম্মেলনে ব্রিকস সদস্যদের নেতৃত্বের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক দেশগুলির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে ৷ কিনতু পাকিস্তানকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি ৷ ভারতের পক্ষে আশার কথা, চিন পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ না জানানোর প্রসঙ্গে কোনও বাক্যব্যয় তো করেইনি, বরং ভারতের এই আঞ্চলিক আলোচনা প্রক্রিয়া আয়োজন করার জন্যে প্রশংসা করেছে ৷
যে আঞ্চলিক দেশগুলির এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা, তারা হল বিমসটেক গোষ্ঠীর অন্তর্গত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড, ভুটান ও নেপাল ৷ এছাড়া, আফগানিস্তান এবং মালদ্বীপও রয়েছে ৷
উরির পরে একঘরে হয়ে পড়া পাকিস্তানকে কি চীন আর শর্তহীন প্রেম দেখাতে পারবে?
উরিতে জঙ্গিহানায় একাধিক ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার পর ভারত-পাক সম্পর্কের তিক্ততা চরমে ওঠে ৷ ভারতীয় সেনাও নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে পাক-মদতপুষ্ট জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানায় ৷ দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, পশ্চিমি বিশ্বও পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে ধিক্কার জানায় ৷
চিনই একমাত্র সহায় ছিল পাকিস্তানের এবং সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘে ভারত জয়েশ জঙ্গিনেতা মাসুদ আজহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আবেদন জানালে চিন তাতে রাজি হয়নি ৷ কিনতু সম্প্রতি পাকিস্তানের 'ডন' পত্রিকার একটি বিশেষ প্রতিবেদনের মতে, চিন বারবার মাসুদের প্রশ্নে পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও এই অবস্থানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ৷ এর আগেও পাঠানকোট হামলার পর চিন একইভাবে মাসুদের প্রশ্নে ভারতের বিরোধিতা করেছিল ৷ অর্থাৎ, পাকিস্তান যে ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে, তা বোধকরি চিনও বুঝছে ৷
পাকিস্তানের অস্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে চিনের অন্দরেও
তাছাড়া, গত সেপ্টেম্বর মাসে চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সিপিইসি বা চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর বলে যে বিপুল প্রকল্প চিন বানাচ্ছে তার পশ্চিমে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল ৷ কারণ আর কিছুই নয়, পাকিস্তানের অস্থিরতা ৷
এটুকু বোঝা আবশ্যিক যে চিনকে আমরা যতই পাকিস্তানের বন্ধু বলি না কেন, বেজিং কিন্তু কখনওই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের পক্ষে নয় ৷ তার পাকিস্তান নীতি আসলে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়াতে ব্যস্ত রাখার কৌশল যাতে বাকি মহাদেশে সে একাই ছড়ি ঘোরাতে পারে ৷
মোদীর কূটনীতি চিনকে যে ভাবায়, তা প্রমাণিত
তবে, মোদী ক্ষমতায় আশার পরে চিনের সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে কারণ এনডিএ সরকারের আমলে ভারতও এশিয়ার অন্যান্য প্রান্তে কূটনীতির দানে চিনকে কোনঠাসা করার খেলাতেও মনোনিবেশ করেছে ৷ এই যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভিয়েতনাম বা পূর্ব এশিয়াতে জাপান বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা বা দক্ষিণ এশিয়াতেও বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কাতে প্রভাব বাড়ানো -- মোদীর জমানায় নয়াদিল্লি চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক দাবাখেলায় সমান উদ্যোগে মেতেছে ৷ আর তাতেই চিন্তা বেড়েছে চিনের ৷
যে প্রতিবেদনে সিপিইসি-র কথা বলা হয়েছে, তাতে চিনা কর্তৃপক্ষকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে মনোনিবেশ করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ৷ তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চিনের পাড়ায় তাঁবু ফেলেছে এবং ভারতের সঙ্গে সখ্য করেছে, তাতে বেজিং-এর যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ রয়েছে বইকি ৷
এই পরিস্থিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যতই চিনা জুজুর কথা শুনিয়ে জাতীয়তাবাদী আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, আদতে চিনের ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনও পরিকল্পনা নেই ৷ তাই ভারতেরও উচিত হবে না চিনকে পাকিস্তানের সঙ্গে একভাবে দেখে বৈরীর অবস্থান নেওয়া ৷
আর বাকি বিশ্ব যেমন পাকিস্তানকে একঘরে করে ভারতের পিছনে দাঁড়িয়েছে, নয়াদিল্লির তরফ থেকে চিনের প্রতিও একটু বনধুভাবাপন্ন মানসিকতা এবং ধৈর্য দেখালে বেজিংও তার অবস্থান কিছুটা হলেও বদলাবে ৷ বেজিংয়ের পাকিস্তান নীতি আসলে ভারতকে চাপে রাখার নীতি ৷ সে নীতিতে বদল আনতে ভারতকেই সচেষ্ট হতে হবে ৷
ব্রিকস-এর আগে চিন তো মিত্রের বার্তা শুনিয়েছে ৷ এবারে দেখা যাক ভারত তার কতটা ফায়দা তুলতে পারে ৷