সিঙ্গুর রোগ ক্রমশ ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র; মমতার 'কালজয়ী মডেল' রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতবে
সিঙ্গুরে জমি ফেরত দেওয়ার পর এখন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ইতিহাসের পিছনে চলা শুরু হয়েছে, এমনকি রাস্তা করার জন্য প্রশাসনও সাহস পাচ্ছে না কৃষকের জন্য জমি চাওয়ার; এই তাহলে মমতার 'বিশ্বকে পথ দেখানোর' মডেল?
কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ গর্ব করে সিঙ্গুরের কংক্রিটে ঢাকা পড়ে যাওয়া জমি আবার কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ইতিহাসকে পিছন দিকে হাঁটালেন।
ইতিহাস সচরাচর ক্ষমা করে না কিনতু দাপুটে তৃণমূল নেত্রীর সামনে বোধহয় সেও কুঁকড়ে গেল। নেত্রী কৃষকদের হারানো জমি ফেরত দিয়ে সগর্বে ঘোষণা করলেন যে সারা বিশ্ব একদিন 'সিঙ্গুর মডেল'কে মেনে চলবে (মডেলটা ঠিক কী সেটা অবশ্য পরিষ্কার নয় এখনও)।
তবে অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে দুনিয়া সিঙ্গুরকে মনে রাখুক বা না রাখুক, তৃণমূলের 'জমি ফেরত অভিযান' ভারতের জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতিতে যে নতুন পালক যোগ করেছে তা অস্বীকার করার যো নেই। কিনতু একই সঙ্গে, সিঙ্গুরকাণ্ড থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলেছেন তার মূল্য তাঁর রাজ্যকে কতটা চোকাতে হবে সেটাও হিসেবে রাখা জরুরি।
সোমবার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে সেই হিসেবের কথাটাই মনে পড়ল। বলা হয়েছে, জমির মালিকের মধ্যে অনেকে সক্রিয় কৃষক হওয়ার ফলে সেই জমি অধিগ্রহণ করার সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর এই ঘটনা দূরে কোথাও নয়, ঘটেছে একেবারে কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে - নিউটাউনে।
সেখানে হিডকো বা হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন নতুন রাস্তা তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়ার পর দেখা গিয়েছে যে যে জমিতে প্রকল্পটি হওয়ার কথা তার কোনওটির মালিক বেসরকারি সংস্থা আবার কোনওটির সাধারণ কৃষক যাঁরা এখনও সেখানে চাষবাস করেন। কুড়ি মাস আগে প্রকল্পটির জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও কাজ এগোয়নি কিছুই কারণ যদি কোনও জমির মালিক - বিশেষ করে কৃষক মালিক যাঁরা - তাঁরা যদি জমি বেচতে রাজি না থাকেন তবে সরকার আর ও পথ মাড়াতে রাজি নয়। তাতে রাস্তা না হলে তাই সই। জমি নেওয়ার জন্য কোনওরকম জবরদস্তি তৃণমূল সরকার করবে না।
অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে "বিশ্ব একদিন মান্য করবে" মডেল বলে সেদিন সিঙ্গুরে চালালেন, সেটি আদতে উন্নয়নের গলায় ফাঁস লাগানোর মডেল। একমাত্র আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত না নিয়ে থাকলে বিশ্বের কোনও দেশ তাতে সায় দেবে বলে মনে হয় না।
কিনতু বঙ্গেশ্বরীর সেসব মানতে বয়েই গিয়েছে। তাঁর হিসেবে সিঙ্গুরে গাড়ি উল্টোদিকে চালিয়েই তিনি কেল্লাফতে করে দিয়েছেন, আট বছর আগে তাঁর একবগ্গা প্রতিবাদের রাজনীতি যে বৈধতা পেল সুপ্রিম কোর্টের রায়তে তাতেই তিনি আহ্লাদিত। চিরশত্রু বামেদের শেষ চিহ্ন - ওই সিঙ্গুরের পরিত্যক্ত ন্যানো কারখানাকে ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে যে পৈশাচিক আনন্দ, তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ তৃণমূলের মতো 'সাব-অল্টার্ন' দল যে করবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যে বোতলের জিন বেরিয়ে পড়ে পুরো রাজ্যের ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার মতো একটা মাথাও কি শাসকদল রয়েছে? রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হেকিম যেমন একদিকে বলেছেন যে সরকার জোর করে জমি নেবে না, অন্যদিকে এটাও আশা করেছেন যে কৃষকদের ভালোভাবে বোঝালে তাঁরা জমি দেবেন। অথচ, প্রতিবেদনটির মতে এই 'বোঝানোর' কাজটি প্রায় দু'বছরে কেউই করতে চায়নি।
আসলে জমি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও নীতিই নেই। সিঙ্গুরের ব্যাপারটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জয়, তার সঙ্গে রাজ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা উন্নয়নের মডেলের কোনওই সম্পর্ক নেই। যদি থেকেই থাকত, তবে প্রশাসন চতুর্দিকে 'সিঙ্গুরে মেঘ' দেখে বেড়াত না।
সিঙ্গুরে জমি ফেরতের পরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতেই ছোট বড় নানা প্রকল্পে দেওয়া জমি এখন মালিকরা ফেরত চাইছেন। সরকারের নীতি থাকলে এই সমস্যাগুলির শুরুতেই মোকাবিলা করা যেতে পারত। কিনতু যেহেতু জমির ব্যাপারে নীতিহীন হওয়াটাই এই সরকারের নীতি (কারণ আগের সরকারের সিঙ্গুর কেলেঙ্কারির পর জননেত্রী কোনওভাবেই মুখ পোড়াতে রাজি নন), তাই সিঙ্গুরের প্রভাব পড়বে অন্যান্য জায়গাতেও এবং মুখে রাজা-উজির মারলেও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব বাস্তবে শিল্পায়নের পথে একচুলও এগোতে পারবে না।
সত্যি বলতে কী, বেসরকারি সংস্থার শিল্পায়ন তো দূরের কথা, সাধারণ প্রশাসনিক কাজের জন্যই জমিতে হাত দেওয়া ক্রমে দুষ্কর হয়ে উঠবে। আর ওই ল্যান্ডব্যাঙ্কের গল্পও কয়েকদিন পরে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। সব মিলিয়ে তখন হাতে থাকবে শুধু পেন্সিল।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম বধের উল্লাস এখনও চলছে। আর সিঙ্গুরপর্ব সেই নাটিকারই একটি অধ্যায়। এই আনন্দানুষ্ঠান একদিন না একদিন শেষ হবে। আর সেদিনও নেত্রী জোর গলায় বলতে পারেন যে সিঙ্গুর বিশ্বকে পথ দেখাবে একদিন, সেটাই এখন দেখার।