দেবকে নিয়ে হাসাহাসি করে লাভ নেই দাদারা, আমার আপনার গণতন্ত্রই কিন্তু ওঁদের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে
ক'দিন আগে ফেসবুকে একজন দেখলাম লিখেছে: "'জুলফিকার' দেখতে যাব কারণ ওতে দেব কথা বলবে না।" অনেকেই দেখলাম 'লাইকিয়েছে' মন্তব্যটি। ভাবখানা এই: যা বলেছ গুরু, এইসব দেব-টেব আবার অভিনেতা নাকি? ও চুপ থাকলেই ভাল।
এই চিন্তাধারার পিছনে কী মানসিকতা তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হল: আজকের দিনেও এই মানসিকতায় কেন পরিবর্তন আসবে না? যদি আমরা আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রার নানা আধুনিক রীতিনীতি, আদবকায়দা নিয়ে কোনও অভিযোগ না করি, তাহলে কেন এক্ষেত্রে করব?
অভিনেতা হিসেবে দেব-এর উত্থান অনস্বীকার্য। দেব, যিনি এখন একজন সাংসদও বটে, বলতে গেলে 'সাবল্টার্ন' দর্শকের এক রোল মডেল। আর সেখানেই বোধহয় তাঁকে ঘিরে যত নাক কুঁচকানির সূত্রপাত। "এক লাইন ইংরেজি বলতে পারে না, ব্যাটা সাংসদ হয়েছে!" এমন কটাক্ষ প্রায়ই শোনা যায়।
যাঁরা এই তির্যক মন্তব্যটি করেন সম্প্রতি সংসদে নিজের কেন্দ্র ঘাটালের উন্নয়নের জন্যে দেবের বক্তব্য শুনে, তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন: "ঘাটালের উন্নতির জন্যে চোস্ত ইংরেজি বলা বাংলার ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এলিট রাজনৈতিক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা কী করেছেন? যদি করেই থাকতেন, তাহলে তো দেব-এর কথা শোনার অবকাশই আজ আসত না, তাই না?"
অতএব, কিভাবে বলছেন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কী বলছেন সেটা বোঝার চেষ্টা করুন ভদ্রমহোদয়গণ। ভাষা নিয়ে ভাববেন না। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও ইংরেজি বলাতে দারুন কিছু ভাল নন কিন্তু তাতে তাঁদের রাজনৈতিক উত্থান থেমে থাকেনি।
অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইংরেজি নিয়েও যে আমরা হাসাহাসি করি না তা নয়। আর এখানেই আমাদের গণতন্ত্রের ব্যর্থতা। গত ৬৯ বছরে আমরা ঠিক এই জায়গাটিতেই পৌঁছতে চেয়েছি আর যখন পৌঁছেছি, তখন ভাবছি: "এ আমরা কোথায় এলাম?"
আমরা আজ নেহরুমার্কা গণতান্ত্রিক মডেল থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের গণতন্ত্রের এখনও অনেক পথ চলা বাকি, কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে আমাদের গণতন্ত্র আজ অনেক আধুনিক। অর্থনৈতিকভাবে আমরা 'চুঁইয়ে পড়া' মডেল গ্রহণ করলেও সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থে কিন্তু আমরা সরাসরি ক্ষমতায়নের পথে হেঁটেছি। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
নেহরুর আমলের 'এলিট গণতন্ত্র' আজ 'জনসাধারণে গণতন্ত্র'-তে পর্যবসিত হয়েছে। আর তাতে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের কিন্তু ক্ষতি কিছু হয়ইনি, বরং লাভই হয়েছে। সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন খাতের প্রসাদপ্রাপ্ত এই শ্রেণীর আজ বিপুল উত্থান ঘটেছে; বিদেশী পণ্য প্রস্তুতকারকরাও আজ ভারতের মধ্যবিত্তের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে লালায়িত।
আমরা এগোতেই পারি, তাই বলে তোরাও এগোবি?
নেহরুকে আমরা আজ আর পাত্তা দিই না, বলি ওই লোকটার জন্যে আজ দেশের এই সমস্যা, সেই সমস্যা। দেশের সমস্যা নিয়ে আজ আমরা ব্যক্তিগতভাবে খুব চিন্তিত তা নয়, কিন্তু তবু নেহরুকে দোষী না ঠাওড়ালে আমাদের ঠিক ভাত হজম হয় না। আসল কারণ অন্য। এলিটিজম কে আমরা ঘৃণা করি কারণ তা আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু মজার ব্যাপার, আমাদের মতোই সামাজিক ক্ষমতায়নের ফলে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া মানুষও যখন এগিয়ে আসে, আমরা তাঁদের নিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকি। ভাবখানা এই: "আমরা এগোতেই পারি, তাই বলে তোরাও এগোবি?"
গণতন্ত্র যে আদতে একটি দু-মুখো তলোয়ার, তা আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না। ভাবি, এই ব্যবস্থা শুধু আমার সুবিধার জন্যে তৈরী। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি স্বার্থপর মানসিকতা নিয়ে চললে তার জবাব গণতন্ত্রই দেবে, আর আমরা শুধুই বিরক্তি লাগাতে ভুগব।
দেবকে না পোষালে অন্য কিছু দেখুন, গণতন্ত্রে দেদার 'চয়েস'
সেভাবে দেখতে গেলে আজকের যুগে সারা দুনিয়া জুড়েই এক ধরণের মেকি সাম্যের ছড়াছড়ি। গণতন্রের আশীর্বাদ বা অভিশাপ যাই বলুন না কেন, এটাই বাস্তব। তাই সেই যুগের মানুষ হয়ে কাউকে প্রকাশ্যে নিচু চোখে দেখা মানে নিজেকেই ছোট করা। যদি মনে করেন দেব আপনার পাতে দেওয়ার মতো অভিনেতা নন, তাহলে সোজা অন্য হলে ঢুকে পড়ুন বা বাড়িতে বসে ব্যক্তিগত পরিসরে ঋত্ত্বিক-সত্যজিৎ দেখুন। কেউ আপনার মেজাজ তেতো করতে যাবে না। গণতন্ত্র যেমন একদিকে আপনার পছন্দের তালিকায় 'মধ্যমেধা'র (বাঙালির আরেকটি বহুলব্যবহৃত শব্দ) সংখ্যা বাড়ায়, তেমনই সেই তালিকার দৈর্ঘ্যও লম্বা করে। অতএব, অসুবিধা দেখবেন না শুধু, সুবিধাটাও দেখুন।
"দেব ইংরেজি বলতে পারেন না, বাংলাও বলতে পারেন না... তাহলে আর কী বাঙালি উনি?"
অবশ্য দেব-এর প্রতি উন্নাসিকতার আরও কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সাংসদ উনি, তাই হাওয়াই চটি-পরা নেত্রীকে বঙ্গীয় ভদ্রলোক শ্রেণী যে'নজরে দেখে, দেবকেও সম্ভবত সেই একই নজরে দেখা হয়। দুই, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেব এখন বঙ্গীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা। এমনকী, উত্তমকুমারের সঙ্গে মহানায়কের তকমা মাঝে মাঝে তাঁকেও দেওয়া হয়। এটাই অতীতমুখী বাঙালির পছন্দ নয়।
সংসদে যেই দেব ইংরেজি বলতে পারেন না বলে সবাই তুলোধোনা করে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ: তিনি বাংলা উচ্চারণে যথেষ্ট পটু নন। সেই একই ভদ্রলোক শ্রেণীর নাক-উঁচু ভাব। এক্ষেত্রেও পরামর্শ একই। উত্তমকুমারের সঙ্গে দেবকে তুলনা করার মাথার দিব্বি কেউ দেয়নি। দেবের সমর্থক, অনুরাগী থাকতেই পারে। গণতন্ত্র খোলা বাজার। এখানে কেষ্টবিষ্টুর সবার অবাধ আনাগোনা।
তাই বলি কী, বুদ্ধিমানের কাজ এইটাই হবে যে গণতন্ত্রের মৌলিক নিয়মটি মেনে নিয়ে সবাইকে সাদরে গ্রহণ করে নিন। রাজনীতিবিদদের যেমন অপছন্দ করছেন (দেব অবশ্য রাজনীতিবিদ নন এখনও) করুন, কিন্তু সমাজের অন্যান্য মানুষকে একই চোখে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওতে নিজেরই সমস্যা বেশি হবে।