কংগ্রেস চলল হিন্দুদের মন পেতে, বিজেপি মুসলমানদের - উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে এই জামা পাল্টাপাল্টি সত্যিই চোখে পড়ার মতো
ভারতীয় রাজনীতি বেশ মজার জিনিস। এখানে রাজনীতিজ্ঞরা নানা ব্যাপারে সবজান্তা হলেও আইডেন্টিটি-র ব্যাপারে প্রায়শই আত্মবিশ্বাসের অভাবে এবং বিভ্রান্তিতে ভোগেন। যখন একধরনের আইডেন্টিটি তৈরী হয়, তখন ভাবেন এটা বোধহয় ঠিকঠাক হচ্ছে না, অতএব ছোটেন স্রোতের উল্টো মুখে। ভয়, ঐদিকের ভোটগুলি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়?
এদেশের প্রধান দু'টি দল - বিজেপি এবং কংগ্রেস-এর এখন এটাই সমস্যা। কয়েকদিন আগে, কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী তাঁর উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন অযোধ্যার হনুমানগড়হি তে পুজো দেন। গান্ধী পরিবারের একজন সদস্যর অযোধ্যার মতো রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত স্থানে যাওয়া নিঃসন্দেহে বড় খবর কিন্তু তার চেয়েও বড় ঘটনা হচ্ছে কংগ্রেস এবং বিজেপি - এই দু'টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বই এখন উত্তরপ্রদেশ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তাই তাঁরা চেষ্টা করছেন প্রথাগত ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে।
রাহুলের মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কয়েকদিন আগে কেরলের কোঝিকোড়েতে দলের জাতীয় পরিষদীয় বৈঠকে বার্তা দেন মুসলমানদের আপন করে নিতে। এরপর দাদরির সেই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের ঠিক একবছর পর সংখ্যালঘুদের মন জিততে বিশেষ কর্মসূচি নিল তাঁর সরকার। দেশের সংখ্যালঘুবহুল এলাকাগুলিতে ৫০০টি 'উন্নতি পঞ্চায়েত' করতে প্রস্তুতি নিয়েছে কেন্দ্র।
গত বছর ২৮শে সেপ্টেম্বর উত্তরপরদেশের দাদরিতে বাড়িতে গোমাংস রাখার অভিযোগে ৫০ বছর বয়সী মহম্মদ ইখলাককে পিটিয়ে মারে একদল লোক, অথচ মোদী সেব্যাপারে মুখ খোলেন অনেক পরে, বিহার নির্বাচনের সময়ে। তাও সেবার মোদী বলেন ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও তাতে কেন্দ্র সরকারের কিই বা করার ছিল?
কিন্তু এখন, সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর পরে মোদীর এবং তাঁর দলের অনেক কিছু করার রয়েছে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে। একই রাজ্যে কংগ্রেস এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ত্বের এই বিশেষ কর্মসূচি কি নেহাতই কাকতালীয়?
একপেশে ভাবমূর্তি ভাঙার প্রচেষ্টা
অবশ্যই নয়। আসলে দুই দলই বুঝেছে, এতদিন ধরে তৈরী হয়ে আসা একপেশে ভাবমূর্তি এবার ভাঙার সময় এসেছে। কংগ্রেস-এর 'ধর্মনিরপেক্ষতার' ভাবমূর্তি যে আদতে সংখ্যালঘু তোষণের খেলার জন্যে তৈরী, তা দেশের মানুষ এখন একপ্রকার নিশ্চিত। আর অন্যদিকে, বিজেপি -- যাদের উত্থান কংগ্রেসের এই সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির ফাঁকফোঁকর গলেই, তারা এবার বুঝেছে দীর্ঘদিন যদি ভারত শাসন করতে হয়, তবে 'সংখ্যালঘুদের সাগরে ছুঁড়ে ফেলার' মানসিকতা থেকে বেরোতেই হবে। মোদী যদ্দিন গুজরাতের নেতৃত্ত্বে ছিলেন, এই দায় তাঁর অত ছিলোনা, কিন্তু এখন দিল্লির মসনদে বসে গোটা ভারতের অধীশ্বর হয়ে তাঁকে অন্যরকম ভাবতেই হচ্ছে। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম।
কিন্তু সেই যদি বিভাজনের সুরই গলায় চড়ে, তবে মোদী কিসের মহান?
কিন্তু দু'দলেরই এই ভোট-কেন্দ্রিক কৌশল মনে জিজ্ঞাসা তৈরী করে। যদি ভাবমূর্তি বদলানোটাই লক্ষ্য হয়, তবে কেন দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন মোদী বা রাহুলকে বিশ্বাস করবেন? সার্বিক উন্নয়নের কথা না ভেবে কংগ্রেসের এই সংখ্যাগুরু বা বিজেপির সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতিকে কেন তাঁরা সমর্থন করবেন? যদি কংগ্রেস অতীতে এই রাজনীতি করে দেশের বড় ক্ষতি করে থাকে, তবে আজ বিজেপিও সেই একই রাজনীতি করবে কেন? তাহলে মোদীর মাহাত্ম্য কী?
তিন দশক আগে রাহুলের পিতা এবং প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী অযোধ্যায় সংখ্যাগুরু তোষণের রাজনীতি করতে গিয়ে ডুবেছিলেন। তাঁর অভিযানের জন্যে সেই যে ১৯৮৯ সালে কংগ্রেস ক্ষমতা হারায় উত্তরপ্রদেশে, আজও তারা তা ফিরে পায়নি। রাজীব নিজেও কেন্দ্রে ক্ষমতাচ্যুত হন সেবছর। রাহুল হয়তো সেটা জানতেন আর সেইজন্যেই হনুমানগড়হির অদূরে রামলালা দর্শনে যাননি। কিন্তু তিনি কি খোঁজ রাখেন যে তাঁর পূর্বসূরিদের বিতর্কিত 'নিরপেক্ষতাবাদ'ই এদেশে বিজেপির মতো 'সাম্প্রদায়িক' দলের সুবিধা করে দিয়েছে?
একই প্রশ্ন মোদীসাহেবকেও। ২০০২ সালে গুজরাতে সংখ্যালঘু-নিপীড়নের প্রবল অভিযোগ ওঠে তাঁরই নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। আর আজকে তিনি যখন ঢাকঢোল বাজিয়ে দেখতে চাইছেন যে উনি আসলে কতটা সংখ্যালঘু-বান্ধব, তখন কি তা তাঁর সমালোচকদের আস্বস্ত করছে না? মোদী যখন প্রশাসক হিসেবে যথেষ্ট প্রশংসা পাচ্ছেন ক্ষমতায় আসার আড়াই বছর পরেও, তখন হঠাৎ এই সংখ্যালঘুদের জন্যে আলাদা প্রেম প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা কি ছিল?
জামা পাল্টাপাল্টি করলে কী হবে, রাজনীতি সেই এক
কংগ্রেসের এই 'সূক্ষ সংখ্যাগুরু তোষণ' এবং বিজেপির 'সূক্ষ সংখ্যালঘু তোষণ' কি উত্তরপ্রদেশের মানুষ বুঝতে পারছেন না? এই দুই দলই তাদের এই বিভাজনের রাজনীতির জন্যে অতীতে মুখ পুড়িয়েছে অথচ তবু তাদের নেতৃত্ত্ব মরিয়া হয়ে একই কৌশল নিচ্ছেন আগামী নির্বাচনগুলোতে ভালো করার জন্যে।দ্ধে একজোট না হয়, সেটাই চেষ্টা শাসক দলের। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এখন তাঁদের কাছেই সরাসরি পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্র।