চিনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে বাস্তববাদী বাংলাদেশ; সজাগ থাকবে ভারত
চিন সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের দিকে বনধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ঢাকাও সমান আগ্রহ দেখিয়েছে; আজকের বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগোচ্ছে বাংলাদেশের বিদেশনীতি।
দক্ষিণ এশিয়ায় বেশিরভাগ সময়েই সংবাদমাধ্যমের নজরে থাকে ভারত-পাকিস্তান বৈরী। এই দুটি দেশের লাগাতার কলহই এই অঞ্চলের রাজনীতি-কূটনীতি জুড়ে রয়েছে অষ্টপ্রহর। কিনতু দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এই দুই দেশের পাশাপাশি একটি তৃতীয় দেশের দিকেও আলোকপাত করা জরুরি এবং তার নাম হচ্ছে বাংলাদেশ।
সন্ত্রাস, ক্রিকেট, মহাকাশ কর্মসূচি বা বিদেশনীতি -- দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটি কিনতু বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আলোড়ন তুলছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক হওয়ার সুবাদে আমাদের দায়িত্ব ঢাকার এই সার্বিক আত্মপ্রকাশ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা।
সাবালক হচ্ছে বাংলাদেশের বিদেশনীতি
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে বাংলাদেশের বিদেশনীতি নিয়ে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই দেশটি কিনতু আজ অনেকটা পথই পেরিয়েছে। ঢাকাকে আজ শুধুমাত্র নয়াদিল্লির পক্ষে না বিপক্ষে - সেই সমীকরণ দিয়ে বিচার করলে চলবে না। এবং তার কারণ, শেখ হাসিনার শাসনকালে ঢাকা আজ আন্তর্জাতিকনীতিতে অনেক পরিণত।
ঢাকা যে ক্রমেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় নিজের জায়গা বানিয়ে নিচ্ছে তার অন্যতম উদাহরণ চিনা রাষ্ট্রপতি জি জিনপিং-এর সেদেশ সফর। এই সফরে উন্নয়নের স্বার্থে জিনপিং বাংলাদেশের ঝুলিতে ঢেলেছেন 2400 কোটি মার্কিন ডলার (ভারত সেখানে দিয়েছে মাত্র ২০০ কোটি)। এছাড়াও হয়েছে নানাবিধ চুক্তি। চিনের তরফ থেকে বাংলাদেশের প্রতি এই স্নেহ যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের দিকে নয়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
চিন বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে কৌশলগত কারণে
বিশেষ করে যখন এই অঞ্চলের পুরোনো মিত্র পাকিস্তান এই মুহূর্তে যথেষ্ট কোনঠাসা আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এবং নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশের নতুন নেতৃত্ব এখন চিনের দিকে অতিরিক্ত ঝোঁকার থেকে ভারতের সঙ্গে মিতালি জোরদার করে শ্রেয় মনে করছে। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো ভূ-কৌশলগত রাষ্ট্রকে কাছাকাছি রাখাটা যে চিনের প্ল্যান বি -- তা বলাই যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গুরুত্ব বাড়িয়েছে ঢাকার
কিনতু এ তো গেল চিনের কথা। বাংলাদেশের বিদেশনীতিতেও কি কোনও বড় রকমের বদল এসেছে যার ফলে ঢাকা অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে পারছে? উত্তরটা অবশ্যই হ্যাঁ। বাংলাদেশে একটানা সাত বছর ক্ষমতায় রয়েছেন হাসিনা। কোনও বিঘ্ন না ঘটলে সেদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক দশক পূরণ করবেন তিনি ২০১৯-এ।
অতএব, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের গণতন্ত্রেরও এটি একটি উজ্জ্বল মুহূর্ত। এবং স্বাভাবিকভাবেই, এই একটানা শাসনের ফলে হাসিনা এখন বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের একটি বিশ্বাসযোগ্যতা তুলে ধরতে পেরেছেন; তার ফলে সে-দেশের গুরুত্ব একটু হলেও বেড়েছে।
শেখ হাসিনা নমনীয় বিদেশনীতিতে বিশ্বাসী
দ্বিতীয়ত, হাসিনা বিদেশনীতিতে একবগ্গা অবস্থান নিয়ে চলেন না। খারাপ সম্পর্কের পাশাপাশি ভালো সম্পর্ককেও তিনি সমান ভাবে গুরুত্ব দেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেমন সন্ত্রাস নিয়ে সরব হন এবং ইসলামাবাদে হতে চলা সার্ক সম্মেলন বয়কট করতে কুন্ঠাবোধ করেন না, তেমনই আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন না। আবার পাকিস্তানের বনধু চিনের থেকে সাহায্য নিতেও ইতস্তত করেন না, এমনকি তাতে পুরোনো মিত্র ভারতের অস্বস্তি বাড়লেও না।
এ বছরের অগাস্ট মাসে সৌদি আরব তাদের মাটিতে বাংলাদেশি কর্মীদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় হাসিনার কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে। এই দৃষ্টান্তগুলি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের বিদেশনীতি শুধুমাত্র আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ নেই; তা এখন আরও আন্তর্জাতিক। জিনপিং-এর চিন সফরও এই নতুন বাস্তবের পরিচয় দেয়। আরেক বড় শক্তি রাশিয়ার সঙ্গেও ইদানিংকালে বাংলাদেশের সখ্য বেড়েছে।
হাসিনা প্রথম থেকেই চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চেয়েছেন
চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সম্পর্কের উন্নতির পিছনে হাসিনার বিশেষ অবদান অনস্বীকার্য। যদিও বাংলাদেশের জন্মের সময়ে চিনের অবস্থান প্রতিকূল ছিল, কিনতু বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন হাসিনা বিশেষ উদ্যোগ নেন বেজিং-এর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার।
বেজিংও এই উদ্যোগকে ব্যর্থ হতে দেয়নি। চিনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উত্থান বাংলাদেশকে আকর্ষিত করে এবং বর্তমান সময়ে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়াও সন্ত্রাস ইত্যাদির প্রশ্নেও এই দুই দেশ নিজেদের অবস্থানে মিল খুঁজে পায়।
চিনের সঙ্গে সুসম্পর্কের মধ্যে দিয়ে নয়াদিল্লিকেও বার্তা দিচ্ছে ঢাকা
কিনতু চিনের সঙ্গে বনধুত্ব গাঢ় করার মধ্যে দিয়ে কি ঢাকা নয়াদিল্লিকে কোনও বার্তা দিতে চায়? সাদামাটা চোখে দেখলে হয়তো নয়, কিনতু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে হ্যাঁ সেটাও একটি উদ্দেশ্য বটে।
যদিও ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অর্থে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যোগসূত্রটি নিবিড়, কিনতু বর্তমান সময়ে ভারতে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে একটি প্রভাব পড়বে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
এই বছর পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের মতো বাংলাদেশের লাগোয়া কয়েকটি রাজ্যে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য গলা তুলে প্রচার করেছে ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপি। তাতে বাংলাদেশি নেতৃত্ব যে খুব একটা আস্বস্ত বোধ করছেন তা নয়।
তাছাড়া, তিস্তা নদীর জল বন্টনকে কেন্দ্র করেও ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে এখনও ফয়সালা হয়নি কোনও। হাসিনা সরকার এই নিয়ে বার বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আবেদন জানালেও ভারতীয় রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাবে ব্যাপারটি এগোচ্ছে না।
নিজের নিরাপত্তার দায় নিজেই নিয়েছে বাংলাদেশ
সব মিলিয়ে, সন্ত্রাসের প্রশ্নে যখন ইসলামিক দুনিয়া দ্বিধাবিভক্ত; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেকের বিদেশনীতিকে আর খুব বেশি প্রসারিত করতে রাজি নয় (সে-দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে) এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ উদারতা দেখাচ্ছে না, তখন নিজের সুরক্ষা দৃঢ় বাংলাদেশকে চিন বা রাশিয়ার মতো দেশের দিকেই মুখ ঘোরাতে হবে বৈকি। আর এই বিদেশনীতির প্রশ্নে নতুন মিত্র এবং অবস্থান নিয়ে চর্চাই ঢাকাকে আন্তর্জাতিক স্তরে সাবালক করে তুলবে।