অধীর যাই বলুন, তাঁর নিজের দোষেই কংগ্রেসের এই নৌকাডুবি
শেষ উইকেটটি ছিল মুর্শিদাবাদ। সেটারও এবার পতন ঘটল। বাংলায় কংগ্রেস এখন বলতে গেলে এক বিলুপ্ত প্রাণী। অথচ এই কয়েকমাস আগেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর বডি লঙ্গোয়েজ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তাঁর নিজের গড়েই এত বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করে রয়েছে। বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে অধীর মৌখিকভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্রাজ্যকে নির্মূল করে ফেলেছিলেন, তাঁর এখন নিজগৃহে পরবাসীর মতো অবস্থা।
সম্প্রতি বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নীলরতন আঢ্য সহ ১৭ জন কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগদান করাতে তিন দশক পরে সেটি কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়ে গেল। মুর্শিদাবাদের 'রবিনহুড'-এর জীবদ্দশায় যে মুর্শিদাবাদের মাটিতে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে, সেটা কিছুদিন আগে পর্যন্ত অভাবনীয় ছিল। অতীতে প্রবল পরাক্রমী বামেরা ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করলেও অধীরের দুর্গে তাঁরা দাঁত ফোটাতে পারেনি। মমতাও তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ত্বের প্রথম পর্বে এই জেলায় সুবিধে করতে পারেননি। এমনকি, এই বছরের বিধানসভা নির্বাচনেও তাঁর দল বিপুল জয় পেলেও বহরমপুর পকেটে পুরতে পারেননি।
অধীর শোনাচ্ছেন ষড়যন্ত্রের গল্প কিন্তু সেটাই কি আসল কারণ?
তবে হঠাৎ এই ধস কেন? অধীরের নিজের মতে, শাসক দল নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কংগ্রেসের মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়েছে। মিথ্যে মামলার হুমকি, টাকার লোভ, চাকরির প্রতিশ্রুতি -- ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা কংগ্রেস থেকে লোক নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের দলে বলে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতির ধারণা। সাধারণ মানুষ এখনও তাঁর সঙ্গেই আছে এবং তিনি তাঁদের বোঝাবেন বলে অধীর পরিকল্পনা নিয়েছেন।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কতটা হয়েছে তা অধীর এবং তাঁর প্রতিপক্ষরাই জানেন, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে অধীরের নিজের কৌশলগত ভুলের জন্যেও কংগ্রেসকে এমন খেসারত দিতে হচ্ছে। ভুলটি আর কিছু নয় -- গত বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে মাখামাখি যা আদৌ কোনও কাজে আসেনি, উল্টে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে অধীরেরই আঙ্গনে।
কংগ্রেসের ভাঙ্গন সর্বত্র
কংগ্রেসের এই ভাঙ্গন কিন্তু শুধু বহরমপুরে হয়েছে তা নয়। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ, প্রতিবেশী জেলা মালদা এমনকি পশ্চিম মেদিনীপুরের একাধিক কংগ্রেস কর্মী যোগ দিয়েছে তৃণমূলে। সবং-এর বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মানস ভূঁইয়াও কয়েক মাসের কোন্দলের পর কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে এবং বলেছেন সেটাই হচ্ছে "আসল কংগ্রেস"। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন অধীরের নেতৃত্ব নিয়েও।
বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই দুর্গতি
বহরমপুরের সাংসদ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর দলেরই সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া বহু সদস্য এবং বর্তমান নেতাও। বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে হাত মেলানোটাই সর্বনাশ ডেকে এনেছে কংগ্রেসের, এমনকি তার নিজের অন্তিম গড়েও বলে অভিমত দলের অনেকেরই। বলা হচ্ছে ইদানিং তাঁকে নাকি আগের মতো আর দরকারে-অদরকারে পাশে পাওয়াও যাচ্ছিল না।
বামদের সঙ্গে বোঝাপড়া ফিরে এল ব্যুমেরাং হয়ে
ধারণাটা ভিত্তিহীন নয়। মুর্শিদাবাদে তৃণমূল কোনওদিনই বড় শক্তি নয়। সেখানে বরং অধীরের মূল প্রতিপক্ষ বামেরাই। তাই বামেদের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে বাকি বাংলায় ভালো ফল করতে গিয়ে অধীর নিজের দুর্গেরই সর্বনাশ করে বসেন। তিনি মুখে বলেছিলেন ঠিকই যে নিচুতলার কর্মীদের দাবি মেনেই এই বোঝাপড়া, কিন্তু আদতে যে তিনি ভুল ছিলেন তা এই অন্তহীন ভাঙ্গনেই প্রমাণিত।
একই দলের মধ্যে অনেক দল
বাংলায় কংগ্রেসের সমস্যা হচ্ছে ও রাজ্যে দলটির মধ্যে বহু উপদল। কোনও শক্তিশালী শীর্ষ নেতৃত্ব না থাকার কারণে (তার মধ্যে এখন ১০ জনপথও পড়ে; বাংলায় কংগ্রেসের এই বিপর্যয়ের দায় সোনিয়া-রাহুল গান্ধীরাও এড়াতে পারেন না ) এই উপদলের হোতারাই কংগ্রেসকে চালিয়ে এসেছেন যে যেভাবে পেরেছেন।
বামেদের দীর্ঘ শাসনকালে কংগ্রেসের বিরোধী দল হিসেবে কোনও কার্যকারিতা ছিল না কারণ তার ঐক্যের অভাব। অতীতে প্রণববাবুকেও দলের মধ্যে কম বিশৃঙ্খলা সইতে হয়নি, মমতা বিরক্ত হয়ে দল ছেড়ে নিজের তৃণমূল তৈরী করেছেন, নানা সময়ে নানা ছোট বড় নেতা কংগ্রেস ছেড়ে মমতার দলে যোগ দিয়েছেন। সিদ্ধার্থশংকর রায়ের পরে ক্যারিশ্ম্যাটিক নেতারও খামতি দেখা দিয়েছিল দলে।
এই নানা সমস্যায় বিদীর্ণ দলটির মাথায় অধীরের মতো একজন উপনেতাকে বসালে যা হওয়ার তাই হয়েছে। চুনোপুঁটিতে ভর্তি দলটিতে "আমি তোমাকে মানব কেন" মানসিকতার এখন রমরমা। দলকে টেনে তোলা তো দূরে থাকে, এখন এই নেতারা এঁর ওঁর হাত ধরে ভেসে থাকতে পারলেই বর্তে যান।
অধীর যে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিলেন প্রথম থেকেই তা তাঁর বাম-ঘেঁষা নির্বাচনী কৌশল দেখেই বোঝা গেছিল। সারা বাংলায় কংগ্রেসের পুনরুত্থান-এর জন্যে যে জনভিত্তি এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন, মমতার একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগে তা অসম্ভব জানতেন অধীর। তাই ভেবেছিলেন তিনি নিজের গড় বাঁচাবেন আর বামেদের হাত ধরে বাকি রাজ্যের বৈতরণী পার হবেন। কিন্তু পুকুরে সাঁতার কেটে কি আর সাগর পার হওয়া যায়? খেয়োখেয়ির ঝড়ঝঞ্ঝায় খেয়া ডুবল মাঝপথেই। আর সেই অভিশপ্ত খেয়ার মাঝি, বাংলার পোড়খাওয়া দুঁদে নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীকে এখন প্রতিপক্ষের হাঁটুর বয়সী নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও শুনতে হচ্ছে কটাক্ষ: "উনি তো নিজের গড়ই সামলাতে পারেন না ।"