৩১ অক্টোবর: মৃত্যুর বত্রিশ বছর পর আমরা ইন্দিরা গান্ধীকে কতটা মনে রেখেছি?
আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে ৩১ অক্টোবর নিজেরই শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আমরা আজকে তাকে কতটা মনে রেখেছি?
আরও একটি ৩১ অক্টোবর উপস্থিত। বত্রিশ বছর আগে এরকমই একটি একত্রিশে অক্টোবর নিজেরই সশস্ত্র দেহরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
ভারতের রাজনীতিতে জওহরলাল নেহরুর কন্যার সেই হত্যাকাণ্ড এক মোড়-ঘোরানো অধ্যায় ছিল। ইন্দিরার স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র রাজীব কিন্তু সাত বছর পরে তাঁকেও প্রাণ দিতে হয়। পরিবারকেন্দ্রিক কংগ্রেস দলে এক দশকের কম সময়ে এই দুই রাজনৈতিক হত্যাকান্ড দেশের সর্বপ্রাচীন দলটির পক্ষে ছিল বিরাট ধাক্কা।
বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু কংগ্রেসের কাছে ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি। ক্ষতি শুধু এই কারণেই নয় যে সেই সময়ে ইন্দিরা ছিলেন ওই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী। ক্ষতি এই কারণেও যে ইন্দিরা গান্ধী যে রাজনীতি আমদানি করেছিলেন তাঁর সময়ে, তাতে তাঁর চলে যাওয়াতে কংগ্রেসে তৈরি হয় এমন এক শূন্যতা যে তা পূরণ করা এককথায় ছিল অসম্ভব।
ইন্দিরা গান্ধী যেমন একদিকে ছিলেন সিংহহৃদয় রাজনৈতিক নেত্রী, তেমনি অন্যদিকে তাঁর রাজনৈতিক কার্যপ্রণালী ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
তাঁর পিতার জমানায় যে কংগ্রেস ছিল একটি গণতান্ত্রিক দল, সারাদেশে ছড়িয়ে ছিল তার শিকড়, ইন্দিরা সেই কংগ্রেসকেই রূপান্তরিত করেন এক কেন্দ্রীভূত গোষ্ঠীতে যেখানে দলের সর্বেসর্বা তিনি এবং তাঁর ছোট পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। এর কারণ হিসেবে ধরা যায় ইন্দিরার ব্যক্তিত্বকেই। ছোট থেকে তাঁর পিতা এবং মা কস্তুরবার মধ্যে সম্পর্ক যে দারুন সহজ ছিল না এবং তাঁর মার অসুস্থ শরীর ইত্যাদি ছোট্ট ইন্দিরার মনে গভীর দাগ কেটেছিল।
পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আচমকা মৃত্যুর পরে কংগ্রেসের সিন্ডিকেট ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করার কথা ভাবে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে। কিনতু প্রিয়দর্শিনী অচিরেই বুঝিয়ে দেন যে তিনি অত সহজে বশ্যতা স্বীকার করার পাত্রী নন।
প্রথম ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মধ্যে আলাদা দল গড়েন তিনি এবং আসল কংগ্রেসের প্রাধান্যকে খর্ব করেন। কিনতু তাঁর মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে ছোট থেকে, তার ফলে ইন্দিরা হয়ে ওঠেন একনায়িকা, কাউকেই যিনি বিশ্বাস করতে পারেন না।
ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ নিজের মুঠোয় রাখতে বাহবা দেন পরিবারবাদকে। নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ঠিক করে ফেলেন সঞ্জয়কেই যদিও ১৯৮০ সালের জুন মাসে বিমান দুর্ঘটনায় ছোট পুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে ইন্দিরার পরিকল্পনা সফল হয়নি (হাঁফ ছেড়ে বোধহয় বেঁচেছে আপামর ভারতবাসীও)। অবশ্য তাতে ইন্দিরার পরিবারবাদের প্রকল্প থেমে থাকেনি। সঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে তিনি রাজনীতিতে নিয়ে আসেন বড় পুত্র রাজীবকে।
কিন্তু এই 'গান্ধীবাদ'এর যাঁতাকলে পড়ে নষ্ট হয় কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি। প্রথমে বিভাজন আর তারপরে ইন্দিরার একনায়িকার সংস্কৃতি দলটিকে তাঁবেদারদের গোষ্ঠীতে পরিবর্তিত করে। আর কংগ্রেসের সংগঠনের অবক্ষয় এবং সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি আস্তে আস্তে জন্ম দেয় সংখ্যাগুরু-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের।
তাঁর শেষ জীবনে ইন্দিরা গান্ধীও সংখ্যাগুরুদের মন পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেই পড়া যায় যদিও সে লক্ষ্যে বেশিদূর যাওয়ার আগেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয় শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে।
তাঁর পুত্র রাজীব বা পরবর্তীকালে পুত্রবধূ তথা বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী এবং পৌত্র রাহুল গান্ধীও সংখ্যাগুরুর প্রাণে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নানা সময়েই কিনতু বড়োদিনে বিজেপির বড় রকমের উত্থান ঘটে যাওয়াতে সেই প্রকল্প আর বিশেষ সফল হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের দিনে যদি ইন্দিরা সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতেন, কতটা কী করতে পারতেন? (সামনের বছর ইন্দিরার জন্মশতবার্ষিকী) ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান সময়ের টানাপড়েন দেখে অনেকেই বলেন ইন্দিরা থাকলে দেখিয়ে দিতেন পাকিস্তানকে। এই ভাবনা যে ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় জয়ের ফলেই আসে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
কিনতু একথাও মনে রাখা উচিত পাশাপাশি যে প্রাক -পরমাণু অস্ত্রের যুগে ভারতের যে 'মিলিটারি লিড' ছিল পাকিস্তানের উপর, তা আজ আর নেই । আর তাই, বর্তমান সময়ে যদি নরেন্দ্র মোদীর জায়গায় ইন্দিরাই প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, তাঁর হাত-পাও বাঁধাই থাকত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার কারণে।
ইন্দিরাকে আজ আমরা কতটা মনে রেখেছি? সরকারি স্তরে, খুব বিশেষ নয়। মোদী সরকার দু'বছর আগে একত্রিশে অক্টোবর ইন্দিরাকে স্মরণ করার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং লৌহমানব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিন পালন। কারণ আর কিছুই নয়, নেহরু এবং তাঁর বংশধরদের ভারতের ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া।
একসময়ে ইন্দিরা এবং তাঁর পরিবারবাদের (হ্যাঁ, পরিবারবাদের সূচনা হয়েছিল ইন্দিরার থেকেই, জওহরলাল থেকে নয়) কল্যাণে গান্ধী ছাড়া আর কোনও নাম ভারতীয় রাজনীতিতে নেওয়া হত না। আর আজ ঠিক তার উল্টোটা ঘটছে। ইতিহাস তার প্রতিশোধ বোধহয় এভাবেই নেয়।