ব্রিকস নিয়ে যতটা হইচই হচ্ছে, আদৌ কি বাস্তবে তা ততটা বর্ষাবে?
সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা) নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এই পাঁচটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতিকে নিয়ে পশ্চিমের বিকল্প মঞ্চ তৈরি হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী অনেকেই। আয়তন, জনসংখ্যা, বাণিজ্য, জিডিপি ইত্যাদির নিরিখে এই পাঁচটি দেশের ব্রিকস আগামীদিনের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠবেই বলে নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু সত্যিই কতটা সাফল্য ব্রিকস পাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যেতে পারে।
বিশ্ব রাজনীতি গত দেড় দশকে বদলেছে; ব্রিকস দেশগুলি অত পোক্ত জায়গায় এখন নেই
প্রথমত, গোল্ডম্যান সাক্স-এর অর্থনীতিবিদ জিম ও'নিল ২০০১ সালে যখন প্রথম এই 'ব্রিক' (হ্যাঁ, তখনও দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি) শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা ভিন্ন ছিল। আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ভয়ঙ্কর জঙ্গিহানার পরে রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুনিয়ার তখন বেশ টলমল অবস্থা।
সেই সময়ে, চিনের চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের দ্রুত উন্নতি এবং রাশিয়া এবং ব্রাজিলের মতো তেল এবং পণ্য-নির্ভরশীল অর্থনীতির রমরমার কারণে মনে করা হয় যে একত্রে এই চারটি বিরাট দেশ বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেক দিক থেকেই প্রভাবিত করতে পারে।
এর পাঁচ বছর পর ২০০৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিক-এর জন্ম হয়। এর চার বছর পরে ব্রিক-এ দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তি ঘটে এবং ব্রিক-এর নাম বদলে রাখা হয় 'ব্রিকস'। ধরে নেওয়া হয় পশ্চিম এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে সেতুর ভূমিকা পালন করবে এই গোষ্ঠী। সাম্য প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করবে।
কিনতু ব্রিকস প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক দশক পর কিনতু বাস্তব পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। এক ভারত ছাড়া বাকি চারটি দেশের, এমনকি চিনেরও, অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেকটাই থমকে গিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং শ্লথ শিল্পপ্রক্রিয়াও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একথা ঠিকই যে বিশ্ব বাণিজ্যের শতাংশের হিসেবে গত এক দশকে ব্রিকস উন্নতি করেছে কিনতু সে কৃতিত্বের সিংহভাগই চিনের প্রাপ্য । ব্রিকস-এর বাকি দেশগুলি (ভারত সামান্য এগিয়েছে যদিও) সেভাবে তাদেরকে ঘিরে দেখা স্বপ্নকে সফল করে তুলতে পারেনি। বর্তমান পরিস্থিতে তারা থমকে গিয়েছে আচমকাই।
ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলির নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক কতটা ভালো?
দ্বিতীয়ত, যে কোনও গোষ্ঠীর সাফল্যের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের নিজেদের মধ্যে মসৃণ সম্পর্ক। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রথম থেকেই। ব্রিকস-এর ক্ষেত্রেও সেই একই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
ব্রিকসএর এই বিপুল আয়তন এবং অর্থনৈতিকভাবে সম্ভনাময় দেশগুলির নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক বা অন্যান্য আদানপ্রদান কতটা? ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিকস-এর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নিশ্চয় বাণিজ্যের এক শতাংশেরও কম।
ভারত আর চিন কি সত্যি একটি গোষ্ঠীর মধ্যে থাকতে পারে?
বিশেষ করে ভারত এবং চিনের বাণিজ্যের পাল্লা বেজিং-এর দিকে এতটাই ভারী যে এই দুই প্রতিবেশী দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ব্রিকস-এর সাফল্যের পথে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আশ্চর্যের কথা আরও যে একদিকে যখন চিনের সঙ্গে ব্রিকস-এর মঞ্চে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি একদিকে, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চিনা দ্রব্য বয়কট করার দাবি শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থানটি বড়ই আশ্চর্যকর। এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় কিভাবে?
ব্রিকস-এর দেশগুলির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তার সাফল্যের জন্য কতটা অনুকূল?
তৃতীয় ও শেষ কারণটি হল কূটনৈতিক বা কৌশলগত। যাঁরা দেখেছি কূটনীতির আঙিনায় বেজিং এবং নয়াদিল্লির বিরামহীন প্যাঁচপয়জার। অরুণাচল সীমান্ত বা পাকিস্তান প্রশ্নে বা ভারতের রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে বা এনএসজিতে প্রবেশের বিষয়ে বা জয়েশ জঙ্গি মাসুদ আজহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ব্যাপারে চীন ক্রমাগত ভারতের বিরোধিতা করে এসেছে।
কৌশলগত দিক থেকেও চিন ভারতকে দক্ষিণ এশিয়াতে ঘিরে ফেলতে চেয়েছে আর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে নয়াদিল্লিও বেজিংকে পাল্টা চাপে রাখার চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম বা জাপানের মতো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়িয়ে। অতএব, একই গোষ্ঠীর সদস্য দেশের মধ্যেই যদি এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে, তাহলে তার সাফল্য পাওয়ার আশা কতটুকু?
মার্কিন-বনধু ভারতকে পুরোনো মিত্র রাশিয়া এখন কতটা বিশ্বাসের চোখে দেখে?
রাশিয়ার সঙ্গেও ভারতের সেই মিত্রতা এখন অতীত। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি যাওয়াতে রাশিয়াও যে চিনের মতোই খুব সন্তুষ্ট তা নয় । যদিও এই সময়ে পুরোনো এই দুই মিত্র প্রতিরক্ষা চুক্তিতে মনোনিবেশ করেছে কিনতু ওয়াশিংটনের সঙ্গে নয়াদিল্লির সান্নিধ্য যে ব্রিকস-এর পরিবেশ খুব একটা সহজ রাখবে না, তা বলা চলে।
ওয়াশিংটনের জন্য মস্কো-বেজিং কাছে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আর কি কোনও সমস্যা নেই?
তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে চিন এবং রাশিয়া আজকাল কাছাকাছি এলেও মধ্য এশিয়ায় চিনা প্রভাব নিয়ে ক্রেমলিন যে কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যতই মুখে তাঁরা "বনধু" হন না কেন, ভ্লাদিমির পুতিন এবং জি জিনপিং-এর জাতীয়তাবাদী জিগির কূটনীতির ময়দানে একে অপরকে খুব একটা জায়গা ছাড়বেন না।
ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়েই ব্যস্ত
অন্যদিকে, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দুর্নীতিমূলক ডামাডোল নিয়ে এত ব্যস্ত যে তাঁদের পক্ষে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ভালোখারাপ নিয়ে কতটা মাথা ঘামানো সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যায়।