কোরাস সিঙ্গার থেকে কিংবদন্তি গায়ক, মহান কিশোর কুমারের জন্মদিনে এক অসামান্য কাহিনি
কেউ একজন বলেছিলেন সাহিত্যে যেমন রবীন্দ্রনাথ। তেমনি আধুনিক ভারতীয় সঙ্গীতে কিশোর কুমার। যার সঙ্গে আলাপ করা যায়। যার গায়িকিতে মানুষ তার মনের কথা খুঁজে পায়।
দিন কয়েক আগে কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হওয়া একটি এফএম চ্যানেল চুরানব্বই ঘণ্টা ধরে কিশোরকুমারের গান বাজানো শুরু করে। এফএম চ্যানেলের আরজে অরবিন্দ শোনাচ্ছিলেন কীভাবে বারো বছরের পরিশ্রমে তিনি কিশোরের অমূল্য় সব গান সংগ্রহ করেছিলেন। প্রতিটি গানের শেষেই চলে আসছিল শ্রোতাদের ফিডব্যাক। কেউ বলছিলেন কিশোরকুমার তাঁর কাছে কতটা মূল্যবান তাঁর গল্প। আবার এক প্রৌঢ়া বলছিলেন এই বয়সেও যেন মনে হচ্ছে এখনই পাখনা মেলে আকাশে ভেসে পড়বে। আর এই আকাশ উড়ানে শুধুই কানে-মরমে বেজে যাবে কিশোরের কন্ঠ।
সালটা ছিল ১৯৮৭-র ১৩ অক্টোবর। বাঙালির ঘরে ঘরে পুজোর ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। আর সেই সময়ে সন্ধ্যার আকাশ ঘনিয়েই এসেছিল দুঃসংবাদটা। কয়েক বছর ধরে নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন বাঙালি সহ তামাম ভারতের 'চলতি কা নাম গাড়ি' তারকা কিশোরকুমার। কিন্তু, ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর মাত্র ৫৮ বছরে তখন কিশোরদা। সে সময় মিডিয়ার দাপাদাপি ছিল দুরস্ত। কিশোরকুমারের সম্পর্কে তথ্য পেতে একমাত্র ভরসা ছিল খবরের কাগজ। তাও কলকাতার মতো বড় শহরগুলোতে বসবাসকারীরা কাগজে পরের দিনই খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, মফস্বলের মানুষের কাছে একই খবরের কাগজ পৌঁছেছিল আরও একদিন পরে। কিশোরকুমার প্রয়াণের টাটকা খবর পেতে তাই তখন ভরসা ছিল দূরদর্শনের সরকারি চ্যানেল আর অল ইন্ডিয়া রেডিও। দূরদর্শনে নির্দিষ্ট সময়ের নামমাত্র কিছু বুলেটিনে কিশোরপ্রয়াণের খবরও কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে আট থেকে আশি সকলেই বারবার কান পাতছিলেন অল ইন্ডিয়ার রেডিও-তে। যেখানে খবরের অধিকাংশটাই জুড়ে থাকছিলেন কিশোরকুমার। আর সংবাদ শেষে সমানে বেজে যাচ্ছিল কিশোরকুমারের একের পর এক অমূল্য গান। ছবিটা যেন মিলে যাচ্ছিল ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর দিনটির সঙ্গে। কারণ, সেবার এভাবেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিয়া গান্ধীর হত্যার খবরে রেডিও স্পিকারে হামলে পড়েছিল আম-জনতা। ইন্দিরা হত্যার প্রায় ৪ বছরের মাথায় ফের একবার দেশবাসী যেন হামলে পড়েছিল রেডিও-র উপরে। ছেলে-ছোকরার দল পাড়ার মোড়ে মোড়ে কিশোরকুমারের ছবিতে মালা টাঙিয়ে সাতদিন ধরে একনাগাড়ে বাজিয়ে গিয়েছিল একের পর এক নন-স্টপ গান।
১৯৮৭ সালের কিশোর প্রয়াণ সামনের ১৩ অক্টোবর তিন দশক ছোঁবে। কিন্তু, প্রয়াণের এত বছর পরও কিশোরকুমার বর্তমান প্রজন্মের সব গায়কদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। কয়েক বছর আগে ক্যাসেট কোম্পানি আরপিজি-র এক কর্তা বলেছিলেন, সারা বছরে এখনও কিশোরকুমারের যা সোলো ক্যাসেট বিক্রি হয় তার ধারে কাছে আসতে পারেন না বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা। এখনও লাখো লাখো কিশোরভক্ত নাকি বিভিন্ন গানের তালিকা তৈরি করে সেই এইসব 'কালেকশন' প্রকাশের আবেদন জানিয়ে ক্যাসেট কোম্পানিতে চিঠি লিখে চলেন।
আসলে কিশোরকুমার মানে একটা উন্মাদনা। কিশোরকুমার মানে একটা ঝলক, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এক কন্ঠ। যা শুধু ভগবানের সন্তান হলেই নাকি পাওয়া যায় বলে দাবি করেন কিশোরপ্রেমীরা। যে কন্ঠ একমুহূর্তে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে দেয় যেন মনে হয় চারিদিকে খিলিখিলিয়ে উঠেছে প্রকৃতি। আবার পরক্ষণেই আলো-আধারি গঙ্গার বুকে নাও ভাসিয়ে এমনভাবে সে কন্ঠ আওয়াজ তোলে যেন মনে হয় এই মানুষটির মনে রয়েছে জগতের সবচেয়ে বড় বিষাদ। প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদনে সেই কন্ঠ আবার আওয়াজ ধরে 'বহুত দূর হোকে বহুত পাস হো তুম...' তখন মনে হয় এর থেকে বড় প্রেমিক আর কেউ হতে পারে না। এটাই কিশোরকুমার তথা বাঙালির কিশোরদা।
গান শেখার কোনও প্রথাগত তালিম ছিল না। ব্রিটিশ রাজ্যের আমলের সেন্ট্রাল প্রভিন্স আধুনা মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডওয়ারের বাঙালি পরিবারের ছেলে আভাষকুমার গাঙ্গুলির ইচ্ছে ছিল বম্বেতে সিনেমায় গান গাওয়ার। দাদা অশোককুমার তখন বম্বেতে প্রতিষ্ঠিত নায়ক। আভাষকুমার নাম বদলে কিশোরকুমার বনে নেমে পড়েছিলেন গায়ক হওয়ার যুদ্ধে। দাদা অশোককুমার অবশ্য চাইতেন ভাই কিশোরকুমার যেন অভিনয়েই মনোনিবেশ করেন। কারণ, কিশোরের অভিনয় প্রতিভায় বিশ্বাস করতেন অশোককুমার। গানের প্রথাগত তালিম না থাকা ভাই কীভাবে বম্বের বুকে গায়ক হবে চিন্তায় ঘুম আসত না দাদার। তারমধ্য়ে বম্বেতে হিন্দি ছবির সঙ্গীত পরিচালনায় তখন তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব। তাই প্রথমদিকে বম্বে টকিজের কোরাস দলে গান গেয়ে গায়ক হওয়ার বাসনা মেটাতে হচ্ছিল কিশোরকুমারকে।
হাল ছাড়েননি কিশোরকুমার। সিনেমায় অভিনয়, গান গাওয়া সমানে চালিয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু, কেউই স্বীকৃতি দিতে রাজি নয় যে কিশোরকুমার আদপে একজন সঙ্গীতশিল্পী। তামাম বম্বে ইন্ডাস্ট্রিতে কিশোরকুমারের গায়িকি শক্তি নিয়ে তাচ্ছিল্যের চটকা ভেঙেছিল ১৯৫৭ সালে। যখন সলিল চৌধুরীর সুরে লতার অনুপস্থিতির খামতি মেটাতে একই সঙ্গে মহিলা ও ছেলের গলায় গান করে দিয়েছিলেন কিশোরকুমার। এরপর আর কেউই কিশোরকুমারকে সঙ্গীতশিল্পীর তকমা না দেওয়ার মতো আস্পর্ধা দেখায়নি।
বম্বের হিন্দি সিনেমার প্লে-ব্যাক সিংগিং-এ তখন পুরুষ গায়কদের মধ্যে সবার আগে একটাই নাম কিশোরকুমার। বম্বে ইন্ডাস্ট্রিতে একমাত্র শচিনকর্তাই প্রথম থেকে কিশোরকুমারের গায়িকিতে ভরসা রেখেছিলেন, সেই শচিনকর্তার সুরে 'আরাধনা'-য় মস্ত হিট করে গেল 'মেরে স্বপ্ন কি রানি' আর 'রূপ তেরা মস্তানা'। শচিনকর্তার ছেলে রাহুলদেব বর্মণ তথা পঞ্চম ও কিশোরের জুটি এরপরে যেন ঝড় বইয়ে দিয়েছিল বম্বের প্লে-ব্যাক সিংগিং-এর জগতে। একটা সময় রাজেশ খান্না পর্যন্ত তাঁর লিপে কিশোরকুমারের গান না থাকলে সিনেমা করতে রাজি হতেন না।
সারা জীবনে হিন্দি থেকে বাংলা, গুজরাটি, মারাঠি, দক্ষিণের ভারতের বিভিন্ন ভাষা, ভোজপুরী-তে হাজারেরও বেশি গান রেকর্ডিং করেছেন। এর মধ্যে শ'য়ে শ'য়ে গান অলটাইম হিটের তালিকায় পড়ে। অভিনয় করেছেন প্রায় শ'খানেক ছবিতে। ১৪টি ছবি প্রযোজনা করেছেন। ১২টি ছবিতে পরিচালক হয়েছে। কলম ধরেছিলেন সিনেমার কাহিনি লেখা থেকে শুরু করে গান লিখতে।
শুধু কি এমনই সব অবিশ্বাস্য কীর্তির জন্য আজও কিশোরকুমার প্রাসঙ্গিক? এখনও এই প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসে। আসলে কিশোরকুমার মানে সুরের এক ফ্যাশন, কিশোরকুমার একটা পাগলামো, আর এমন এক গায়ক যে জীবনের সব হিসেবকে উল্টে দিতে পারত শুধুমাত্র গান গেয়ে। তাই হয়তো কিশোরকুমারের মাদকতা থেকে রেহাই পাওয়া সত্যিকারে কঠিন। সেই কারণে, তাঁর ৮৮তম জন্মদিনেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন কিশোরকুমার। এটাই তো কিশোরম্যাজিক।