স্টেজে গান করার কথা শুনলেই পালিয়ে যেতেন কিশোরকুমার, এমনই অবাক করা একডজন কাহিনি
কিশোরকুমার কি শুধুই একজন সঙ্গীতশিল্পী? এমন প্রশ্ন করার সাহস আজ পর্যন্ত কেউই দেখাননি। কারণ, কিশোরকুমার মানে গান আর অভিনয়ের এক জমাট মিশেল। যার সঙ্গে জুড়ে যায় আস্ত একটা জীবন।
প্রথম শুরু কোরাস গায়ক হিসাবে। তারপর সিনেমায় অভিনয়। কিন্তু, আভাষকুমার গাঙ্গুলির মনে গায়ক হওয়ার তীব্র জেদ। চিরপরিচিত নামটা বদলে নিয়ে হয়ে গিয়েছেন কিশোরকুমার। তারপর যা ঘটেছিল তা তো ইতিহাস। কিশোরকুমারকে নিয়ে রয়েছে এমনই সব মজাদার কাহিনি। তারই কিছু গল্প রইল আপনাদের জন্য।
[আরও পড়ুন:কোরাস সিঙ্গার থেকে কিংবদন্তি গায়ক, মহান কিশোর কুমারের জন্মদিনে এক অসামান্য কাহিনি]
কিশোরকুমার গান শুরু করলে বাড়ির লোক কান চাপা দিয়ে থাকত!
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। খাণ্ডওয়ারের বাড়িতে কিশোরকুমারের তখন ছোটবেলা। তখন তিনি আভাষ নামেই পরিচিত। কিন্তু, ছেলের বেজায় শখ গান গায়। হেড়ে গলার সেই গানে কানের পর্দা ফাটার জোগাড় হত বাড়ির লোকের। কেউ ছোট্ট কিশোরকুমারের পিছু ধাওয়া করত গান বন্ধ করানোর জন্য। কেউ আবার কানে হাত চাপা দিয়ে গান নামক সেই ত্রাহি রব থেকে বাঁচার রাস্তা খুঁজতেন। কিন্তু, কিশোরকুমার নাছোড়। শত বাধাতেও হার মানতেন না। আর তার এই গান গাওয়ার প্রীতি তাঁকে বাড়ি থেকে পাড়ায় হাসির খোরাক বানিয়ে ছেড়েছিল।
স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় শিক্ষকের কার্টুন এঁকেছিলেন কিশোরকুমার
বদমাইশিতে কারোর থেকে কম যেতেন না। ক্লাস ফাইভে স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিল না ছোট্ট কিশোর। তাই, গোটা খাতায় জোকস, কবিতা, নক্সা, হিজিবিজি আর শিক্ষকের কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন।
'পাঁচ রূপাইয়া বারা আনা' গানটি কিশোরকুমারের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছিল।
'চলতি কা নাম গাড়ি'-র এই গানটি বিশাল জনপ্রিয় হয়েছিল। বলিউডে আজও সর্বকালীন অন্যতম রোমান্টিক সঙ হিসাবে এই গানটিকে ধরা হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ইন্দৌরের খ্রিস্চিয়ান কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কিশোরকুমার। কলেজ ক্যান্টিনে ৫টাকা ১২ আনা পেতেন কিশোরকুমার। পরে কোনও দিন সেই টাকা নেওয়া হয়নি। সেই 'পাঁচ রূপাইয়া বারা আনা'-কে নাকি পরে গানের ছন্দে বাঁধেন কিশোরকুমার।
কলেজের বেঞ্চে তবলা বাজানো ছিল কিশোরকুমারের অন্যতম নেশা
একবার সিভিক ক্লাস চলাকালীন কলেজে এভাবে বেঞ্চে তবলা বাজাচ্ছিলেন কিশোরকুমার। এরজন্য শিক্ষকের কাছে কড়া ধমকও খান তিনি। কিন্তু, কিশোরকুমারের পাল্টা উত্তর ছিল গান গেয়েই তিনি অর্থ উপার্জন করবেন। তাই এখন থেকে এভাবেই হাত ও গলা পাকাচ্ছেন।
কলেজ জীবন থেকেই কালো কোটের প্রতি প্রবল দুর্বল ছিলেন কিশোরকুমার
একটা সময় কিশোরকুমার মানেই লম্বা কালো কোট, পাজামা, গলায় মাফলার পরা একটা ছোট্টখাট্টো মানুষ। আসলে কলেজে পড়ার সময় থেকেই নাকি এভাবে কোট পরাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল কিশোরকুমারের। একদিন কোট না পরলেই নাকি অস্থির হয়ে যেতেন তিনি।
এতটাই লাজুক ছিলেন যে গান গাওয়ার নাম শুনলে নাকি দৌড়ে পালিয়ে যেতেন
খুব কম লোকেই জানেন জীবনের একটা বিশাল সময় পর্যন্ত প্রচণ্ডই লাজুক ছিলেন কিশোরকুমার। বিশেষ করে কেউ মিউজিক কনসার্টে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেই পালিয়ে যেতেন। একবার প্লে-ব্যাক সিংগার অ্যাসোসিয়েশন-এর ফান্ড রেইজিং প্রোগ্রামে গান গাওয়ার কথা ছিল কিশোরকুমারের। তাঁর স্টেজে ওঠার আতঙ্কের কথা অ্য়াসোসিয়েশনের অনেকেই জানতেন। তাই তালাত মামুদের উপর দায়িত্ব ছিল কিশোরকুমারকে ঠেলে স্টেজে তোলার। কিন্তু, তালাত মামুদ বাড়িতে গিয়ে দেখেন কিশোরকুমার ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন। পরে সুনীল দত্ত কিশোরকুমারের স্টেজ আতঙ্ক দূর করেছিলেন।
এমন সব কাণ্ড করতেন যে লোকে থই পেত না
যেমন যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রযোজকের কাছ থেকে পুরো পয়সা পেতেন ততক্ষণ নাকি গোঁফ অর্ধেক কেটে রাখতেন কিশোরকুমার। এমনকী, মাথার চুলের অর্ধেক অংশ ছেটে দিতেন। মুম্বইয়ের ওয়ার্ডেন রোডের ফ্ল্যাটে একবার এক সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছিলেন। যাতে লেখা ছিল 'কিশোরকুমার থেকে সাবধান'। এমনকী, খাণ্ডওয়ার বাড়িতে নেমপ্লেট লাগানোর বদলে 'মেন্টাল হসপিটাল' লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
একবার এক পরিচালকে ভালরকমের জব্দ করেছিলেন
কিশোরকুমার তাঁর কথা শুনে অভিনয় করছেন না। এই অভিযোগে সিনেমার শ্যুটিং স্পট থেকে কিশোরকুমারকে সোজা আদালতে নিয়ে গিয়েছিলেন এক পরিচালক। কিশোরকুমারও কম যান না। বিষয়টি সম্মানে লেগেছিল তাঁর। ছবির এক দৃশ্যে কিশোরকুমারের গাড়ি চালানো শ্যুট করা হচ্ছিল। কিন্তু, কিশোরকুমার গাড়ি আর থামাচ্ছিলেন না। এর ফলে প্রোডাকশনের লোকজনকেও কিশোরকুমারের পিছন পিছন ছুটতে হচ্ছিল। অনেকক্ষণ পরে মুম্বইয়ে পানভেলে গিয়ে গাড়ি থামান। উত্তেজিত পরিচালক তখন কিশোরকুমারকে কিছু বলতে পারছে না। কারণ তিনি কিশোরকুমারকে 'কাট' শব্দটাই বলতে ভুলে গিয়েছিলেন।
তিন ব্যক্তির ছবি সবসময় নিজের ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কে এল সায়গল এবং ড্যানি কায়ে-কে নিজের গুরু বলে মানতেন কিশোরকুমার। খাণ্ডওয়ার বাড়িতেই কলেজ জীবনে এই তিন জনের ছবি দেওয়ালে টাঙিয়েছিলেন কিশোরকুমার।
মুখে বেনারসী পান নিয়ে অমিতাভের জন্য গান রেকর্ড করেছিলেন
'খাইকে পান বেনারসওয়ালা' গানটি রেকর্ডের সময় মুখে বেনারসী পান পুড়েছিলেন। আর গানের মাঝে মাঝে মুখ থেকে পানের পিক মেঝের উপর ফেলেছিলেন। কিশোরকুমার পরে জানিয়েছিলেন এতে গানে বেনারস-এর ফিল তিনি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
কিশোরের এই বিশেষ গায়িকি দক্ষতা সকলকে অবাক করেছিল
'যোডলিং' হল গানের এমন একটা পদ্ধতি যেখানে গায়ককে দক্ষতার সঙ্গে একদমে গলা ওঠা-নামা করাতে হয়। স্বাভাবিক কন্ঠ থেকে স্বরকে একবারে উচ্চগামে নিয়ে যেতে হত। সঙ্গীতের কোনও প্রথাগত তালিম না থাকার সত্ত্বেও কিশোরকুমার যেভাবেই এই দক্ষতাকে রপ্ত করেছিলেন তাতে অবাক হয়েছিলেন অনেকে। কিশোরকুমারের স্বরের এই দক্ষতা তাই বাহবা কুড়িয়েছিল 'জিন্দেগি এক সফর', 'চলা যাতা হু কিসি কি ধুন মে'-র মতো গানে।
ওয়াচম্যানের ভুলে আনন্দ-এ অভিনয়ের সুযোগ হাতছাড়া
'আনন্দ' ছবির জন্য পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জি প্রথমে কিশোরকুমার ও মেহমুদকে বেছেছিলেন। কিন্তু, হৃষিকেশ মুখার্জিকে বাড়িতেই ঢুকতে দেননি কিশোরকুমারের বাড়ির দারোয়ান। কারণ, কিশোরকুমার এক বাঙালি পরিচালককে বাড়িতে ঢুকতে দিতে বারণ করেছিলেন। দারোয়ান মনে করেছিলেন হৃষিকেশ মুখার্জি সেই বাঙালি পরিচালক। যার ফলে আনন্দ-এ কিশোরকুমারের চরিত্রটি চলে যায় রাজেশ খান্নার কাছে।