For Quick Alerts
ALLOW NOTIFICATIONS  
For Daily Alerts
Oneindia App Download

​"আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী"

এক হাতে নিজেরই কাটা মুণ্ডু, অপর হাতে কাতরি। কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে উঠেছে তিনটি রক্তের ধারা। দেবী নিজের ছিন্ন মুণ্ডকে রক্তপান করাচ্ছেন। হ্যাঁ, ইনিই দেবী ছিন্নমস্তা বা প্রচণ্ডচণ্ডিকা।

  • By Shuvro Bhattacharya
  • |
Google Oneindia Bengali News

হিন্দু দেবমণ্ডলীতে নগ্ন ও কবন্ধাকার দেবীরা ছিলেন যৌনশক্তির প্রতীক। তাঁদের যৌনাঙ্গের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই নাকি তাঁদের কবন্ধাকার কল্পনা করা হত !

এক হাতে নিজেরই কাটা মুণ্ডু, অপর হাতে কাতরি। কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে উঠেছে তিনটি রক্তের ধারা। দেবী নিজের ছিন্ন মুণ্ডকে রক্তপান করাচ্ছেন। রক্তপান করছেন, দেবীর দুই সখিও। আর দুই পায়ে দলছেন সংগমরত এই যুগলকে। এই রূপ আমাদের সকলেরই চেনা। হ্যাঁ, ইনিই দেবী ছিন্নমস্তা বা প্রচণ্ডচণ্ডিকা। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা।

​"আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী"

কিন্তু কে এই দেবী ছিন্নমস্তা? কেনই বা হিন্দুরা এমন উগ্রমূর্তি এক দেবীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন?কারণ, এই দেবী ছিন্নমস্তা আত্মবলিদান ও কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের প্রতীক। অন্যদিকে তিনি একাধারে যৌনশক্তি ও যৌনসংযমের প্রতীক। আবার অপর এক দিক থেকে দেখলে, তিনি জগজ্জননীর জীবনদাত্রী ও জীবনহন্তী-এই দুই পরস্পরবিরোধী সত্ত্বার যুগলমূর্তি। বর্তমান নিবন্ধে তন্ত্র, পুরাণ ও আধুনিক গবেষকদের মতামত ঘেঁটে দেখব, ছিন্নমস্তার মূর্তিতে মাতৃসত্ত্বা, আত্মবিধ্বংসী ক্রোধ ও কামলালসার দমন-এই তিনটি আপাতবিচ্ছিন্ন ভাবধারা কেমন সুচারুভাবে গ্রথিত হয়েছে একটি মালায়।

কোথা থেকে এলেন দেবী ছিন্নমস্তা ?

দেবী ছিন্নমস্তার উৎস সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত। একটি মত অনুসারে, দেবী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে প্রবেশ করেছেন। অপর মতে, কালী প্রভৃতির মতো ছিন্নমস্তাও এক প্রাচীন বৈদিক দেবীর বিবর্তিত রূপ।

তান্ত্রিক ও তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের দেবী বজ্রযোগিনী বা বজ্রবারাহীর একটি ছিন্নমস্তক মূর্তি আছে। এই মূর্তির নাম ছিন্নমুণ্ডা। মূর্তিটি অনেকটা আমাদের ছিন্নমস্তার মতোই। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে দেবী ছিন্নমুণ্ডার একটি জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া যায়: দুই বোন মেখলা ও কনখলা ছিলেন কৃষ্ণাচার্যের শিষ্যা। উভয়েই ছিলেন মহাসিদ্ধা। তাঁরা নিজেদের মাথা কেটে গুরুকে উপহার দেন এবং তারপর নৃত্য শুরু করেন।

দেবী বজ্রযোগিনীও ওইরকম মুণ্ডহীন বেশে এসে তাদের সঙ্গে নৃত্যে যোগ দেন। অপর একটি বৌদ্ধ কাহিনিতে পাই, গুরু পদ্মসম্ভবের এক শিষ্যা পূর্বজন্মে ছিলেন রাজকুমারী লক্ষ্মীঙ্করা। রাজশাস্তি গ্রহণ করে তিনি নিজের মাথা কেটে নগর পরিক্রমা করলে নগরবাসী তাঁকেই ছিন্নমুণ্ডা-বজ্রবারাহী রূপে পূজা করে।

গবেষক বিনয়তোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধগ্রন্থ সাধনমালা (১১৫৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং হিন্দুগ্রন্থ ছিন্নমস্তাকল্প ও তন্ত্রসার (সপ্তদশ শতাব্দী) প্রভৃতি আলোচনা করে এই মত প্রকাশ করেছেন যে, বৌদ্ধদের ছিন্নমুণ্ডা ও হিন্দুদের ছিন্নমস্তা একই দেবী; পার্থক্য শুধু দেবী ছিন্নমস্তার নাগযজ্ঞোপবীত (সাপের তৈরি পৈতে) ও পায়ের তলায় শায়িত কামরতির মূর্তিতে। এই দুইটি ছিন্নমুণ্ডার মূর্তিতে অনুপস্থিত।

সাধনমালা-য় দেবীর নাম সর্ববুদ্ধা এবং তাঁর সহচরীদ্বয়ের নাম বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণনী। আশ্চর্যজনক নামের মিল দেখা যায় তন্ত্রসার-এ। সেই গ্রন্থে তাঁর নাম সর্বসিদ্ধি এবং তাঁর সহচরীদের নাম ডাকিনী, বৈরোচনী ও বর্ণনী। দুই দেবী মিলে গিয়েছেন ছিন্নমস্তাকল্প-এ এসে। এই গ্রন্থে দেবীর নাম সর্ববুদ্ধি এবং তাঁর সহচরীদের নাম বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণনী। বিনয়তোষবাবুর মতে, সপ্তম শতাব্দীতে পূজিতা বৌদ্ধদেবী ছিন্নমুণ্ডাই হিন্দুদেবী ছিন্নমস্তার উৎস।

তবে বিনয়তোষবাবুর এই মত বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। শঙ্করনারায়ণ প্রমুখ গবেষক দেবী ছিন্নমস্তার বৈদিক যোগসূত্রটির অনুসন্ধান করেছেন। একটি মতে, বৈদিক দেবী নিঋতির বৈশিষ্ট্যগুলি পরবর্তী অর্থাৎ পৌরাণিক যুগে কালী, চামুণ্ডা, করালী, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি দেবীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়।

যে দুই হিন্দু ধর্মগ্রন্থে প্রথম দেবী ছিন্নমস্তার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেদুটি বই হল মহাভাগবত পুরাণ (আনুমানিক ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও দেবীভাগবত পুরাণ (আনুমানিক ১১০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)। দুটিই শাক্ত পুরাণ। এলিজাবেথ অ্যানি বার্নার্ডের মতে, উৎস যাই হোক না কেন, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে যে দেবী ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমুণ্ডার পূজা প্রচলিত ছিল এবং মহাসিদ্ধারা তাঁর পূজা করতেন-একথা অনস্বীকার্য।

​"আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী"

কারেল আর. ভ্যান কুইজ আবার তান্ত্রিক দেবী বারাহী ও চামুণ্ডার মধ্যেও ছিন্নমস্তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। গবেষক ডেভিড কিংসলে কিন্তু মেনে নিচ্ছেন ছিন্নমস্তার বৌদ্ধ উৎসের কথা। তবে তাঁর মতে, সেটাই একমাত্র উৎস নয়। দেবী ছিন্নমস্তায় এসে মিশেছে অন্যান্য প্রভাবও। তাঁর মতে, মহাবিদ্যার ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীতে। আর আগেও হিন্দু দেবমণ্ডলীতে নগ্ন ও কবন্ধাকার দেবীরা ছিলেন এবং ছিন্নমস্তার রূপের বিবর্তনে এঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

এই সব দেবীরা নাকি ছিলেন যৌনশক্তির প্রতীক; আর তাই তাঁদের যৌনাঙ্গের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তাঁদের কবন্ধাকার কল্পনা করা হত-এমনটাই গবেষক কিংসলের মত। তবে তাঁর এই তত্ত্ব ছিন্নমস্তার সামগ্রিক রূপকল্পটির ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। কেউ কেউ বলেন যে, এমনও হতে পারে, কুচক্রী যুদ্ধদেবী কোটাভী ও দক্ষিণ ভারতীয় মৃগয়াদেবী কোরাভাই-এর রূপটি ছিন্নমস্তার রূপ কল্পনার পিছনে অনুপ্রেরণার কাজ করেছিল। কোনো কোনো মতে, কোটাভি মাতৃকা-নাম্নী দেবীমণ্ডলীর সদস্য। তিনিও নগ্না বা বিস্রস্ত বসনা এবং ভীষণাকার।

বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত পুরাণ মতে, তিনি বিষ্ণুর শত্রু। অন্যদিকে কোরাভাইও ভীষণাকার। তিনি যুদ্ধ ও বিজয়ের দেবী। সেই হিসেবে দু-জনের যোগ যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে। ছিন্নমস্তার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের কিন্তু কোনো যোগ নেই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, হিন্দু পুরাণের নগ্না ও ভীষণাকৃতি দেবীরা দৈত্যরক্ত পান করে থাকেন। ছিন্নমস্তাই একমাত্র যিনি নিজের মুণ্ড ছিন্ন করে নিজেরই রক্ত পান করছেন।

গল্পকথায় ছিন্নমস্তা -

তন্ত্রে-পুরাণে দেবী ছিন্নমস্তাকে ঘিরে বেশ অনেকগুলি উপকথা দানা বেঁধেছে। গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্র ও মুণ্ডমালা তন্ত্র-এ দশমহাবিদ্যার দশজন শক্তিদেবীকে বিষ্ণুর এক এক অবতারের উৎস রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত দুটি তন্ত্র মতে ছিন্নমস্তা যথাক্রমে নৃসিংহ ও পরশুরাম অবতারের উৎস।

মহাভাগবত পুরাণ-এ দশমহাবিদ্যার উৎপত্তির গল্পটি পাই: দক্ষের মেয়ে দাক্ষায়ণী (সতী) বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিবকে বিয়ে করেন। এহেন "লাভ ম্যারেজ" দক্ষ মোটেও মেনে নিতে পারেন না। কারণ, শিবকে তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।

যাই হোক, কিছুদিন পর দক্ষ এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। নিজের মেয়ে-জামাইকে বাদ দিয়ে সকল দেবদেবীকে সেই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ জানালেন দক্ষ। দাক্ষায়ণী ভাবলেন বুঝি, কাজের বাড়িতে নানা কাজের চাপে বাবা তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে ভুলে গেছেন। তিনি বিনা নিমন্ত্রণেই যজ্ঞ দেখতে যাওয়ার জন্য শিবের অনুমতি চাইলেন। শিব কিন্তু শ্বশুরের মন বুঝেছিলেন। তিনি বললেন, "তোমার বাবা নিমন্ত্রণ করেননি। বিনা নিমন্ত্রণে যাওয়া কি ভাল দেখায়?"

কিন্তু দাক্ষায়ণীও ছাড়বার পাত্র নন। শিব একটু জেদ করতেই তিনি শিবকে ভয় দেখাবার জন্য দশ মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। সেই দশ ভীষণাকার দেবীমূর্তি দশ দিক থেকে শিবকে ঘিরে ধরল। এই দশ মূর্তি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত। এঁদের মধ্যে ছিন্নমস্তা ছিলেন পশ্চিমে, শিবের ডানদিকে। শেষমেষ শিবকে স্ত্রীর আবদারের কাছে হার মানতেই হল। (কাহিনির পরবর্তী অংশ অনেকেরই জানা এবং এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলে তা আর কথিত হল না) অপর একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব পার্বতীর প্রতি বীতরাগ হয়ে গৃহত্যাগ করতে চাইলে পার্বতী দশমহাবিদ্যার রূপ ধরে শিবের পথ রোধ করেন। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, দশমহাবিদ্যা দেবী শাকম্ভরীর অংশসম্ভূতা ও তাঁর যুদ্ধসহচরী।

নারদ পঞ্চরাত্র ও স্বতন্ত্র তন্ত্র থেকে দেবী ছিন্নমস্তা ও তাঁর দুই সহচরীর জন্মকাহিনি সংকলিত হয়েছে প্রাণতোষিণী তন্ত্র-এ। স্বতন্ত্র তন্ত্র মতে, একদা শিব ও চণ্ডিকা (পার্বতী) রতিসংগমে রত ছিলেন। চণ্ডিকা ছিলেন বিপরীত রতিতে। এমতাবস্থায় শিবের বীর্যস্খলন হলে চণ্ডিকা ক্রুদ্ধ হন। ক্রোধবশে তাঁর দেহ থেকে ডাকিনী ও বর্ণনী নামে দুই সহচরীর জন্ম হয়। কাহিনির পরবর্তী অংশ নারদ পঞ্চরাত্র ও স্বতন্ত্র তন্ত্র উভয় গ্রন্থেই পাওয়া যায়: মন্দাকিনী নদীতে (স্বতন্ত্র তন্ত্র মতে পুষ্পভদ্রা) স্নান করতে যাচ্ছিলেন দেবী পার্বতী। এমন সময় তিনি কামার্ত হয়ে পড়েন। কালো হয়ে যায় তাঁর গায়ের রং।

এদিকে দেবীর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণনী (এঁরাই জয়া ও বিজয়া নামে পরিচিত) সেই সময় ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। পার্বতী বাড়ি ফিরে তাঁদের খেতে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু সঙ্গিনীদের ক্ষুধার্ত অবস্থা দেখে তাঁর নিজেরই কষ্ট হয়। তখন তিনি নখের আঘাতে নিজের মস্তক ছিন্ন করে সঙ্গিনীদের রক্তপান করান। পরে সকলে বাড়ি ফিরে আসেন। দুটি লোকশ্রুতিও আছে দেবী ছিন্নমস্তাকে ঘিরে।

একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী: দেবাসুর যুদ্ধে দেবতারা মহাশক্তির সাহায্য প্রার্থনা করলে দেবী প্রচণ্ডচণ্ডিকা (শাক্তপ্রমোদ গ্রন্থের মতে প্রচণ্ডচণ্ডিকা ছিন্নমস্তারই অপর নাম) দেবতাদের সাহায্য করতে আসেন। দেবী ক্রোধোন্মত্তা হয়ে দৈত্যনাশ করেন। কিন্তু দৈত্যনাশের পরও তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়নি। এই অবস্থায় তিনি নিজের মাথা কেটে রক্তপান করেন। অপর লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সমুদ্রমন্থনে উত্থিত অমৃতে অসুরদের ভাগটি দেবী ছিন্নমস্তা পান করেন এবং তা থেকে অসুরদের বঞ্চিত করার জন্য তিনি নিজের মাথাটি কেটে ফেলেন।

এই চারটি গল্পের অর্থ কী ?

প্রাণতোষিণী তন্ত্র-এ উল্লিখিত গল্পদুটিতে ধরা পড়েছে মায়ের আত্মত্যাগের আদর্শটি। প্রথম লোকশ্রুতিটি আমাদের চিনিয়ে দেয় ক্রোধের আত্মবিধ্বংসী রূপটি। আর দ্বিতীয় লোকশ্রুতিটি লোকহিতার্থে আত্মত্যাগের আদর্শটিকে মহৎ করে তোলে।

ছিন্নমস্তা দেবী প্রত্যালীঢ় ভঙ্গীতে দন্ডায়মানা,গলায় তার নাগ যজ্ঞের উপবীত। সর্বদা ছিন্ন মস্তক ও খড়্গে ভূষিতা, দিগবসনা, নিজ কবন্ধের দ্বারা সানন্দে অমৃতকল্প রক্তধারা পানরতা, সর্পের মুকুট মনি দ্বারা ভূষিতা, ত্রিনয়না, বক্ষদেশ পদ্মে ভূষিতা, বিপরীত বিহারে রতা এবং দেবীর গাত্র বর্ণ জবা ফুলের ন্যায়। পীনোন্নত পয়োধরা, সদা ষোড়শ বর্ষীয়া। তাঁর একদিকে মুক্তকেশী লোহিতসৌম্যা, দিগম্বরী বর্ণিনী ও অন্যদিকে প্রলয় অগ্নির মতো ডাকিনী শক্তি। এঁরা দেবীর ছিন্ন কন্ঠের রক্তপানে রতা। দেবী ছিন্নমস্তার পদতলে সকাম রত মদন ও রতি দেবী থাকেন।

ছিন্নমস্তা মহাবিদ্যা। এঁনাকে উগ্র মহাবিদ্যাও বলা হয়। 'নারদপঞ্চরাত্র' শাস্ত্র মতে এই দেবীর আবির্ভাবের একটি ঘটনা আছে।এই ছিন্নমস্তা দেবীর উদ্ভব সম্পর্কেও একটি কাহিনি এক পুরাণে আছে। নারদপঞ্চরাত্রের মতে, একদিন দেবী পার্বতী তাঁর দুই সহচরীদের নিয়ে মন্দাকিনীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর মনে হঠাত্ কামনা জেগে ওঠে, তার ফলে তিনি অনুরাগে রক্তবর্ণা হন। তাঁর সহচরীদ্বয়ও এই সময় ক্ষুধার্ত হয়ে তাঁর কাছে খাদ্য প্রার্থনা করেন। দেবী তাঁদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন বাড়ি গিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করব।

কিন্তু বারবার তারা ক্ষুধার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করলে এই জয়া-বিজয়া-ডাকিনী-বর্ণিনী রূপে মায়ের দুপাশ থেকে খাদ্য প্রার্থনা করলে করুণাময়ী জননী তাদের এই প্রার্থনা শুনে নিজের বাম নখাগ্র দিয়ে নিজেরই মস্তক ছিন্ন করে সেটি নিজের বামকরতলে ধারণ করলেন। ছিন্ন মস্তক ও কণ্ঠ থেকে ত্রিধারায় রক্তস্রোত প্রবাহিত হতে লাগল। বাম ও দক্ষিণ দিক থেকে নির্গত দুটি ধারা দুই সখি জয়া ও বিজয়ার ভয়ঙ্করী মূর্তি ডাকিনী ও বর্ণিনীর ঊর্ধ্বমুখ লেলিহান জিহ্বায় সংযোজিত হল। আর মধ্যধারাটি নিজ ছিন্ন মুখে পড়তে লাগল। এই ভাবে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে সখীদের পরিতৃপ্ত করেছিলেন বলে তাঁর নাম হল ছিন্নমস্তা।

কী অপার করুণা মায়ের! সন্তানদের ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর করতে তিনি স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে নিজ রক্তে তাদের পরিতৃপ্ত করেন। সহচরী গণ তৃপ্ত হলে দেবী কৈলাশে ফিরে গেলেন। পুনরায় তিনি হলেন শিব জায়া গৌরী।

আপাতদৃষ্টে ছিন্নমস্তা ভয়ঙ্করী মূর্তি হলেও এর তাত্পর্য অসীম। পরিবর্তনশীল জগতের অধিপতি হচ্ছেন কবন্ধ। আর কবন্ধের শক্তি হলেন ছিন্নমস্তা। বিশ্বের হ্রাস বৃদ্ধি হয়েই চলেছে। হ্রাসের মাত্রা কম বিকাশের মাত্রা বেশী হলে যেমন দেবী ভুবনেশ্বরীর আবির্ভাব হয় তেমনি তার বিপরীত হলে ছিন্নমস্তার আবির্ভাব হয়।

দশমহাবিদ্যার প্রতিটি রূপের আলাদা অর্থ আছে। বিদ্যার অর্থ কৌশল। তন্ত্রের দশমহাবিদ্যা দশ রকম সাধনার কৌশল ব্যক্ত করেছেন। ছিন্নমস্তা তত্ত্ব হল ব্রহ্মবিদ্যার কৌশল। 'ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পুর্নাত পূর্ণমুদচ্যতে' মন্ত্র টি ব্রহ্মের সর্বাবস্থায় পূর্ণত্ব বোধক। ছিন্নমস্তা তত্ত্ব ঐ পূর্ণত্বের প্রতীক। ছিন্নমস্তার আবার আত্ম বলিদান ও কুণ্ডলিনী জাগরণের প্রতীক। ছিন্নমস্তার শরীরে সর্প থাকে। সর্প কুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। ছিন্নমস্তা কামরতা মদন রতির ওপর দাঁড়ানো। এর অর্থ মা কামনা বাসনাকে পদতলে দমন করছেন। মা হলেন পূর্ণ বৈরাগ্য ও ব্রহ্মচর্যের প্রতীক। তাই কেবল মাত্র ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসীরাই ছিন্নমস্তার পূজার অধিকারী।

ছিন্নমস্তা কুণ্ডলিনী জাগরণের দেবী। তাঁকে একাধারে যৌনসংযম ও যৌনশক্তির প্রতীক মনে করা হয়।যৌনসংগমরত যুগল মেরুদণ্ডের শেষ অস্থির উপর অবস্থিত মূলাধার চক্রের প্রতীক। কুণ্ডলিনী দেহের কেন্দ্রে সুষুম্না নদীপথে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মতালুতে অবস্থিত সহস্রারে আঘাত করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সুষুম্না দেবীর সহস্রারে এত জোরে আঘাত করে যে, দেবীর মস্তক ছিন্ন হয়ে যায়।

ঊর্ধ্বমুখে রক্তস্রোত চক্রের গ্রন্থি ছিন্ন করার প্রতীক। এই গ্রন্থি মানুষকে দুঃখিত, অজ্ঞ ও দুর্বল করে। ছিন্নমস্তক তুরীয় চৈতন্যের প্রতীক। কুণ্ডলিনী যখন সহস্রারে অবস্থানকারী শিবের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন তিনটি রক্তধারা অমৃতের ধারায় পরিণত হয়। অন্যমতে, ডাকিনী, যোগিনী ও ছিন্নমস্তা হলেন ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নামে তিনটি সূক্ষ্ম নদীর মুক্তধারার প্রতীক।সুষুম্না মূলধার ও সহস্রারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটি মেরুদণ্ডের সমান্তরালে প্রবাহিত। ইড়া দক্ষিণ অণ্ড থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত প্রবাহিত। শীতল চান্দ্র শক্তি ও মস্তিস্কের দক্ষিণ ভাগের সঙ্গে এটি সংযুক্ত। পিঙ্গল বাম অণ্ড থেকে দক্ষিণ নাসারন্ধ্র পর্যন্ত প্রবাহিত। তপ্ত সৌর শক্তি ও মস্তিস্কের বাম ভাগের সঙ্গে এটি সংযুক্ত।

অন্যদিকে তিনি একাধারে দিব্যজননীর জীবনদাত্রী ও জীবনহন্তা সত্ত্বারও প্রতীক। তাঁর আত্মবলিদানের কিংবদন্তিটির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর মাতৃসত্ত্বা, যৌন কর্তৃত্ব ও আত্মবিধ্বংসী ক্রোধ। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা হলেও এককভাবেও তাঁর পূজা প্রচলিত। উত্তর ভারত ও নেপালে ছিন্নমস্তার একাধিক মন্দির রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের ছিন্নমস্তা মন্দিরটিও প্রসিদ্ধ। তবে গৃহস্থবাড়িতে তাঁর পূজা করা হয় না। কেবলমাত্র তান্ত্রিক, যোগী ও সর্বত্যাগীগণ বীরাচার মতে তাঁর পূজা করে থাকেন।তন্ত্রমতে, সাধককে নিজ নাভিতে যোনি চক্রের প্রতীক রক্তসূর্যচক্র কল্পনা করতে বলা হয়েছে। মনে করা হয়, এই চক্রের মধ্যেই ছিন্নমস্তার জনপ্রিয় রূপটির অবস্থান।

নিজের মস্তক ছিন্ন করা, মিথ্যা ভাব, অজ্ঞতা ও আমিত্ব অপসারণের প্রতীক। মস্তক ছিন্ন করেও জীবিত থাকা অলৌকিক শক্তি ও কুণ্ডলিনী জাগরণের প্রতীক।দেবী ও দুই যোগিনীর ত্রয়ীমূর্তি বস্তুর তিন অবস্থার দার্শনিক প্রতীক, যার সঙ্গে সৃষ্টিশক্তিরও সম্পর্ক বিদ্যমান। নগ্নতা ও মস্তকহীনতা দেবীর সত্যরূপ ও "আত্মসচেতনতাহীনতা"-র প্রতীক। ছিন্নমস্তা যৌনসংগমরত কামদেব ও রতিদেবীর উপর দণ্ডায়মানা। এর দুটি ব্যাখ্যা আছে। এক পক্ষের মতে, এটি যৌনকামনার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। অপর পক্ষের মতে, এর অর্থ দেবী যৌনশক্তির মূর্তিস্বরূপ। তাঁর যোগিনী ও মদনাতুরা ("যিনি কামকে নিয়ন্ত্রণ করেন") নামদুটি তাঁর যৌনশক্তি নিয়ন্ত্রণ ও দমনকারিণী যোগশক্তির পরিচায়ক। কোনো কোনো চিত্রকল্পে ছিন্নমস্তা কাম-রতির উপর উপবিষ্ট।

এই চিত্রে দেবীর দমনকারিণী মূর্তি দেখা যায় না। এখানে কাম-রতি দেবীকে যৌনক্ষমতা প্রদান করেন। কোনো কোনো মূর্তিতে দেবীকে শিবের সঙ্গে সংগমরতা অবস্থাতেও দেখা যায়। ছিন্নমস্তার কামেশ্বরী ও রতিরাগবিবৃদ্ধিনী নামদুটি এবং তাঁর মন্ত্রে ক্লীং বীজের উল্লেখ (যা কামদেব ও কৃষ্ণের মন্ত্রেও উপস্থিত) এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। অর্থাত কামকে সঙ্গে নিয়ে এবং তাকে যথাবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সাধনপথে লাগানোর তত্ব প্রকাশ পাচ্ছে মায়ের এই রূপে।

বৌদ্ধ ধর্মেও এই দেবীর পূজা দেখা যায়। তিব্বতী বজ্রযোগিনী দেবীর সাথে ছিন্নমস্তার সাদৃশ্য রয়েছে। এই দেবীকে ছিন্নমুন্ডা দেবী নামেও ডাকা হয়। বৌদ্ধ তন্ত্রে ছিন্নমস্তার আবির্ভাব একটু অন্য রকমে বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণাচার্যের শিষ্যা ছিলেন মেখলা ও কনখলা । এঁরা সম্পর্কে দুই বোন। এঁনারা তন্ত্র সাধনা তে সিদ্ধ হয়ে সিদ্ধা হন। একদা তাঁরা নিজেদের মাথা কেটে গুরুদেবকে উপহার দেন। তারপর তাঁরা নৃত্য শুরু করেন । দেবী বজ্রযোগিনী সেখানে প্রকট হয়ে নৃত্যে যোগ দান করেন।

অপর একটি তিব্বতী মত অনুসারে পদ্ম সম্ভব নামক এক গুরুর শিষ্যা ছিলেন রাজকুমারী লক্ষ্মীঙ্করা। রাজ্যের শান্তির জন্য তিনি নিজ মুন্ড কেটে নগর পরিভ্রমণ করেন। নগর লোকেরা তাকে ছিন্নমুন্ডা বজ্রবারাহী রূপে পূজা করতেন।গবেষক বি. ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সাধনমালা (১১৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), হিন্দু ছিন্নমস্তাকল্প ও তন্ত্রসার (সপ্তদশ শতাব্দী) প্রভৃতি গ্রন্থ আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, বৌদ্ধ ছিন্নমুণ্ডা ও হিন্দু ছিন্নমস্তা একই দেবী।

কেবলমাত্র দেবী ছিন্নমস্তা নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী এবং রতি-কামদেবের উপর দণ্ডায়মানা। বৌদ্ধ সাধনমালা গ্রন্থে তাঁর নাম সর্ববুদ্ধা এবং তাঁর সহচরীদের নাম বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণনী। হিন্দু তন্ত্রসার গ্রন্থে তাঁর নাম সর্বসিদ্ধি এবং তাঁর সহচরীগণ হলেন ডাকিনী, ও বর্নিনী। ছিন্নমস্তাকল্প গ্রন্থে দেবীর নাম সর্ববুদ্ধি এবং তাঁর সহচরীদের নাম বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুরূপ।

পদ্ম ও যৌনসংগমরত যুগল জীবন জীবনসৃষ্টির আকুলতার প্রতীক। এরা ছিন্নমস্তক দেবীকে জীবনীশক্তি প্রদান করে। দেবীর কবন্ধ থেকে রক্তের নির্গমন মৃত্যু ও জীবনীশক্তি ক্ষয়ের প্রতীক। এই ক্ষয়িত শক্তি তাঁর সহচরী যোগিনীদের মুখে প্রবেশ করে তাঁদের পুষ্ট করে।ছিন্নমস্তা নিজেকে ও নিজের রক্তকে উত্সর্গ করেছেন। সেই রক্ত তাঁর সহচরীগণ পান করে বিশ্বচরাচরকে পুষ্ট করেছেন।একটি স্তবে তাঁকে ত্যাগ, ত্যাগী ও ত্যাগ গ্রহণকারী বলা হয়েছে। কারণ তাঁর ছিন্নমস্তক একটি বলি।

ছিন্নমস্তা হিন্দুসমাজে এক সুপরিচিত দেবী। বিভিন্ন দেবী মন্দিরের দশমহাবিদ্যার সঙ্গে তাঁর পূজা প্রচলিত। তবে একক দেবী হিসেবে তিনি খুব একটা জনপ্রিয় নন। তাঁর নিজস্ব মন্দিরের সংখ্যা হাতে গোনা। এককভাবে তাঁর সার্বজনীন পূজা সুপ্রচলিত নয়। তান্ত্রিক, যোগী ও সর্বত্যাগীগণ বীরাচারী তান্ত্রিক মতে তাঁর পূজা করে থাকেন। কিংসলের মতে দেবী ভীষণা এবং তাঁর পূজা করা বা তাঁর নিকটে যাওয়া বিপজ্জনক - এই রকম বিশ্বাস থাকায় তাঁর পূজা জনপ্রিয়তা পায়নি। ছিন্নমস্তার শতনাম ও সহস্রনাম স্তোত্রে দেবীর ভীষণা প্রকৃতি ও ক্রোধের উল্লেখ আছে। এই সকল নামে তাঁকে প্রেতসেবিতা ও রক্তপানকারিণী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি নররক্ত ও নরমাংসে প্রীতা হন। দেহরোম, মাংস ও ভয়ংকর মন্ত্রে তাঁর পূজা করা হয়।

তন্ত্রসাধকগণ সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা লাভের জন্য ছিন্নমস্তার পূজা করেন।ছিন্নমস্তার মন্ত্র শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা নারী বশীকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাঁর মন্ত্র কাউকে মন্ত্রচালিত করা বা কারোর ক্ষতি করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। কাব্যশক্তি, সুস্থতা, শত্রুবিজয়, বিঘ্নোপসারণ, রাজপ্রসাদ লাভ, অন্যকে আকর্ষণ, শত্রুরাজ্য জয় ও মোক্ষলাভ - মহাবিদ্যা আরাধনার এই সকল উদ্দেশ্যেও ছিন্নমস্তার পূজা করা হয়।

তন্ত্রসার, শাক্ত প্রমোদ ও মন্ত্র মহোদধিহ (১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) নামক তন্ত্রগ্রন্থে ছিন্নমস্তা ও অন্যান্য মহাবিদ্যার পূজাপদ্ধতি, যন্ত্র এবং ধ্যানমন্ত্র সহ অন্যান্য মন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। তন্ত্রমতে, সাধককে নিজ নাভিতে যোনি চক্রের প্রতীক রক্তসূর্যচক্র কল্পনা করতে বলা হয়েছে। মনে করা হয়, এই চক্রের মধ্যেই ছিন্নমস্তার জনপ্রিয় রূপটির অবস্থান। তন্তসার গৃহস্থকে কেবল নিরাকার রূপেই ছিন্নমস্তার পূজা করতে বলেছেন।

এই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে, যদি কোনো নারী মন্ত্রে ছিন্নমস্তাকে আবাহন জানান, তবে তিনি ডাকিনীতে পরিণত হন, স্বামী-পুত্র হারান এবং শেষে পরিপূর্ণ যোগিনী হন। শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থে কেবল বামমার্গে দেবীর পূজা করতে বলা হয়েছে। মন্ত্র মহোদধিহ গ্রন্থমতে, স্ত্রী ভিন্ন অপর নারীর সঙ্গে যৌনসংগম ছিন্নমস্তা পূজার অঙ্গ। শাক্ত প্রমোদ গ্রন্থেও পূর্বোক্ত মত সমর্থন করে যজ্ঞ ও রাত্রিকালে মদ্য ও মাংস যোগে দেবীর পূজার কথা বলা হয়েছে। কোনো কোনো স্তবে বলা হয়েছে, দেবী রক্তে সন্তুষ্ট হন। তাই তাঁর পূজায় রক্ত বলিদান করা হয়। শক্তিসংগম তন্ত্র মতে একমাত্র বীরেরাই বামমার্গে দেবীর পূজার অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শাক্ত প্রমোদ গ্রন্থে বলা হয়েছে, সঠিক ভাবে দেবীর পূজা না করলে দেবী পূজকের মস্তক ছিন্ন করে রক্ত পান করেন। এই গ্রন্থে গৃহস্থ ও ত্যাগীর জন্য পৃথক পন্থায় ছিন্নমস্তার পূজার বর্ণনা রয়েছে।

হিমাচল প্রদেশের চিন্তাপূর্ণী ছিন্নমস্তা মন্দির একটি শক্তিপীঠ। কথিত আছে, এই মন্দিরে সতীর কপাল পড়েছিল। দেবী এখানে ছিন্নমস্তিকা এবং কপাল উভয় রূপেই পূজিতা হন।বারাণসীর নিকটবর্তী রামনগরের ছিন্নমস্তা মন্দিরে তান্ত্রিকরা শবদেহ নিয়ে দেবীর পূজা করেন। ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের (বৈদ্যনাথ) নিকটবর্তী নন্দন পর্বত এবং রাঁচিতে অন্যান্য মহাবিদ্যার সঙ্গে ছিন্নমস্তারও বেদী রয়েছে। অসমের কামাখ্যা মন্দির চত্বরেও অন্যান্য মহাবিদ্যার সঙ্গে ছিন্নমস্তার বেদী বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরে একটি বিখ্যাত ছিন্নমস্তা মন্দির রয়েছে। নেপালের কাঠমাণ্ডু উপত্যকা চাঙ্গু নারায়ণ মন্দিরের কাছে একটি ছিন্নমস্তা মন্দির রয়েছে। বারনার্ডের মতে, এই সকল মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতমটি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত।

দেবী ছিন্নমস্তা দর্শনে যত ভয়ঙ্করী হোন না কেন, তাঁর রূপের ব্যাখ্যা আর মহিমা জানা থাকলে ওই ভয়াবহ মূর্তিই প্রেমময় বোধ হবে।

দশমহাবিদ্যার অন্যতমা তিনি

সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনি 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ'-এর ক্লাইম্যাক্স গিয়ে ঠেকেছিল ঝাড়খণ্ডের (তখন বিহার) রামগড় জেলার এই মন্দিরটিতে। সন্দেহ হয়, মানিকবাবু তাঁর রহস্য কাহিনির পটভূমিকায় ছিন্নমস্তাকে রেখেছিলেন একটা জবরদস্ত ব্যাকড্রপ হিসেবে। দেবীর ভয়াবহ রূপটিকে পিছনে রেখেই জটিল হয়েছিল রহস্য আর তদন্ত।

​"আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী"

মহাশক্তির দশটি মহাবিদ্যাকে নিয়ে ভাবতে বসলে অনেকের কাছেই কয়েকটি রূপ অস্বস্তিকর ঠেকতে পারে। বিশেষ করে ধূমাবতী এবং ছিন্নমস্তার রূপ সত্যিই ভয়ের আবহ তৈরি করার সামর্থ্য রাখে। মহাবিদ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী, ধূমাবতী ঘোর রহস্যময় এক শক্তি। কিন্তু দেবী ছিন্নমস্তা দর্শনে যত ভয়ঙ্করী হোন না কেন, তাঁর রূপের ব্যাখ্যা আর মহিমা জানা থাকলে ওই ভয়াবহ মূর্তিই প্রেমময় বোধ হবে। দেবী ছিন্নমস্তা সারা দেশেই পূজিতা। কিন্তু ছিন্নমস্তার মহিমাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে গেলে পৌঁছতে হবে রাজরাপ্পায়।

রামগড় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২৮ কিমি দূরত্বে এক টিলার উপরে এই মন্দির। কাছেই বিখ্যাত রাজরাপ্পা ফলস, দামোদর আর ভৈরবী নদীর মোহনা। পুরুষ দামোদরের বুকে জলপ্রপাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া নারী ভৈরবীর দৃশ্য শুধু প্রাকৃতিক বৈভবের কথা বলে না, এই জলতরঙ্গে মিশে থাকে কাহিনি-কিংবদন্তি-মিথ। তবে রাজরাপ্পার আসল আকর্ষণ তার প্রকৃতি নয়, এ কথা রাজরাপ্পায় আগত সব পর্যটকই জানেন।

রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তা মন্দির অতি প্রাচীন। এই দেবস্থানকে অন্যতম শক্তিপীঠ বলে মনে করেন তন্ত্রবিশ্বাসীরা। দেবীরূপ অবশ্য ততটা প্রাচীন নয়। ছিন্নমস্তার মূর্তি একেবারেই শাস্ত্রানুগ এখানে। দেবী নিজহস্তে ধরে রেখেছেন তাঁর ছিন্ন মস্তক। কণ্ঠ থেকে নির্গত হচ্ছে তিনটি রুধিরধারা, যার মধ্যধারাটি পান করছেন দেবী স্বয়ং। বাকি দু'টি ধারা গিয়ে পড়ছে তাঁর দুই সহচরী যোগিনীদের মুখে। দেবীর পদতলে শায়িত রয়েছেন রতিদেবী ও মদনদেব। দেবী কামদলনী। মোক্ষস্বরূপা।

এই ত্রিধারাকে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার প্রতীক বলে ধরা হয়। কামকে দলন করে কুলকুণ্ডলীনির জাগরণকেই ব্যক্ত করে এই মূর্তি। ছিন্নমস্তার উৎস সন্ধান করতে হলে যেতে হবে 'মহাভাগবৎ পুরাণ'-এ। দক্ষ শিবরৃকে তাঁর যজ্ঞা আমন্ত্রন না জানানোয় ক্রুদ্ধ সতীদেবী দশ মহাবিদ্যের রূপ ধরেন। ছিন্নমস্তা তাঁদেরই অন্যতম। তাঁরা শিবকে কেন্দ্র করে দশ দিকে অবস্থান করেন। ছিন্নমস্তার অবস্থান শিবের ডানদিকে।

ছিন্নমস্তা দর্শনের পরেই রয়েছে রাজরাপ্পার দু'টি উষ্ণ প্রস্রবণ। এখানকার জল বহু রোগের উপশম ঘটায় বলে লোকবিশ্বাস।

রাজরাপ্পা দেবী মন্দিরের ভৈরব হলেন রুদ্র মহাদেব। তিনিই এই মন্দিরে রক্ষক হিসেবে পূজিত। মন্দিরে দেবীর শিলারূপ বিদ্যমান। মূল মন্দিরকে ঘিরে মহাবিদ্যাদের অন্যান্য মূর্তিরও মন্দির এখানে রয়েছে। রয়েছে হনুমান ও সূর্যের মন্দিরও।

রামগড় থেকে গাড়িতে ছিন্নমস্তা মন্দির যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। রামগড়ে বিভিন্ন বাজেটের হোটেল রয়েছে।

English summary
Some unknown facts about Devi Chhinnamasta
চটজলদি খবরের আপডেট পান
Enable
x
Notification Settings X
Time Settings
Done
Clear Notification X
Do you want to clear all the notifications from your inbox?
Settings X